—ফাইল চিত্র।
উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ এ দেশে যে আর স্রেফ প্রভাব খাটানোয়, কিংবা ‘নিজেদের লোক’কে শাসনশীর্ষে বসিয়ে দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই, মালুম হল সাম্প্রতিক একটি বিলে। গত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় পেশ করেছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব ম্যানেজমেন্ট (সংশোধন) বিল ২০২৩— যার উদ্দেশ্য বিধেয় সবই আসলে আইআইএম-এর মতো উচ্চমার্গের ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির শাসনব্যবস্থা ও পরিচালনায় সরকারের ‘হাত’ শক্তপোক্ত করা। এ কথাটি এই সূত্রে মনে করিয়ে দেওয়া ভাল— আইআইটি বা আইআইএম-এর মতো ভারতীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তত্ত্বগত ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন হলেও তাদের পরিচালন ও শাসনব্যবস্থা চলে স্বায়ত্তশাসনে, নিজস্ব বিধিব্যবস্থা মতে, উচ্চশিক্ষার প্রসারে এবং পড়াশোনা ও গবেষণার সার্বিক উৎকর্ষে পৌঁছতে যার কোনও বিকল্প নেই।
নিজস্ব সেই স্বাধীনতাই নতুন বিলে খর্ব হওয়ার মুখে। এত দিন যা মেনে কাজ চলছিল, সেই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব ম্যানেজমেন্ট ২০১৭ আইন অনুসারে আইআইএমগুলির মুখ্য প্রশাসক তথা ‘ডিরেক্টর’ নিযুক্ত হতেন বোর্ড অব গভর্নরস দ্বারা, বোর্ডের তৈরি সার্চ কমিটির অনুমোদিত নামের প্যানেল থেকে। বোর্ডে চেয়ারপার্সন ছাড়াও থাকতেন আরও এমন তিন সদস্য, প্রশাসন শিক্ষা শিল্প বিজ্ঞান-পরিসরে যাঁরা বিশিষ্ট। সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল অত্যল্প। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে ডিরেক্টরদের নিয়োগ ও অপসারণ দুই ক্ষেত্রেই সরকারের রীতিমতো ক্ষমতা থাকবে; ভারতের রাষ্ট্রপতি হবেন আইআইএমগুলির ‘ভিজ়িটর’, ডিরেক্টর বাছাইয়ের আগে তাঁর অনুমতি নিতে হবে বোর্ডকে, তাঁর হাতেই থাকবে প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম ‘অডিট’ ও দরকারে অনুসন্ধানের নির্দেশ দানের ক্ষমতা, তিনি যেমন প্রয়োজন বোধ করবেন তেমন পদক্ষেপ করতে পারবেন। নতুন আইনে সার্চ কমিটির এক জন সদস্য— কার্যক্ষেত্রে চেয়ারপার্সনই— হবেন ভিজ়িটর-মনোনীত, অর্থাৎ চেয়ারপার্সন নিয়োগের ক্ষমতাটিও বোর্ডের হাত থেকে চলে যাবে।
এই সবই আশঙ্কা জাগায়। কারণ আইআইএমগুলির ‘ভিজ়িটর’ হিসাবে ভারতের সম্মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে বসিয়ে দিলেও এ কথা সকলেরই জানা যে রাষ্ট্রপতির কাজ আসলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সাহায্য ও পরামর্শ মোতাবেক ‘চলা’। সুতরাং, প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর ও বোর্ডের চেয়ারপার্সন নিয়োগ থেকে শুরু করে সার্বিক শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তথা শাসক দলই পিছন থেকে কলকাঠি নাড়বে, এ ভয় মোটেই অমূলক নয়। অর্থাৎ এই আইন সংশোধনের অর্থ প্রকারান্তরে আইআইএমগুলির স্বশাসনে কোপ। গত চার বছরে বেশ কিছু মুখ্য নিয়োগ ঘিরে কেন্দ্রীয় সরকার ও আইআইএম-কর্তৃপক্ষের বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে, সেই জন্যই আইনপথে সরকারের এই ‘প্রত্যাঘাত’ কি না, তা-ও ভাববার। সাম্প্রতিক কালে কখনও আইআইটি, কখনও দেশের নানা প্রান্তে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাথাতেও ‘নিজেদের লোক’ বসিয়ে বিজেপি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গঠন, শাসন ও নিয়ন্ত্রণ কব্জা করার যে চতুর খেলা খেলছে, সেই ধারাতেই আইআইএম নবতম সংযোজন— বললে খুব ভুল হবে কি? খেলা এ বার ক্ষমতার জোরে আইন পাল্টে, ভিতরের রূপটি যদিও সেই একতান্ত্রিকই।