শিল্পপতিদের সহিত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট-পরবর্তী বৈঠকে শিল্পপতিরা উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছিলেন যে, দেশে মহিলা কর্মীর সংখ্যা কমিতেছে। বাংলাদেশ অথবা শ্রীলঙ্কার তুলনায়ও ভারতের শ্রম বাজারে মহিলা কর্মী কম। শুনিয়া কেন্দ্রীয় অর্থসচিব টি ভি সোমনাথন প্রশ্ন করিয়াছেন, তবে কি শিল্পপতিরা চাকরিতে মহিলাদের সংরক্ষণ দাবি করিতেছেন? তাঁহাকে প্রশ্ন করা জরুরি যে, সংরক্ষণ ভিন্ন মহিলাদের কর্মসংস্থানের অপর কোনও উপায় কি সরকারের জানা নাই? ভারতের শ্রমবাহিনীতে মহিলাদের অনুপাত বহু বৎসর নিম্নমুখী, লকডাউন পর্বে তাহা দ্রুত কমিয়াছে। জাতীয় স্তরের নানা সমীক্ষায় ধরা পড়িয়াছে যে, অতিমারি-কালে মহিলাদের কাজ হারাইবার হার সর্বাধিক। লকডাউন অন্তে পুরুষদের অধিকাংশ কাজ পাইলেও, মহিলারা পান নাই। শিল্পপতিরাও ওই বৈঠকে বলিয়াছেন যে, লকডাউন এবং তাহার পর কর্মী ছাঁটাই মহিলা কর্মীদের সংখ্যা কমিবার প্রধান কারণ। কিন্তু ইহাও স্পষ্ট যে, এই সমস্যার সূত্রপাত অতিমারির বহু পূর্বে— ২০১৭-১৮’র জাতীয় সমীক্ষা দেখাইয়াছিল, ২০০৪-০৫ সালের তুলনায় মহিলাদের শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণ ধারাবাহিক ভাবে কমিয়াছে। এমনকি শহরবাসী, শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যেও বেকারত্ব বাড়িয়াছে। অধিক লেখাপড়া, পেশাদারি প্রশিক্ষণ, কিছুই আরও অধিক সংখ্যায় মেয়েদের কাজের জগতে আনিতে পারে নাই। এই বিষয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বিপরীত দিকে যাত্রা করিতেছে ভারত।
ইহার কারণ লইয়া গবেষণা কম হয় নাই, কিন্তু অর্থনীতির বিবিধ তত্ত্ব ও তথ্যে বিচরণ করিয়া সকল ব্যাখ্যা কখনও না কখনও ঘুরিয়াছে সমাজ ব্যবস্থায়। ‘সনাতন’ প্রথা অনুসারে নারীর স্থান গৃহে নির্দিষ্ট করিবার ইচ্ছা, বিবাহ ও মাতৃত্বকে অতিরিক্ত সামাজিক মূল্য দান ভারতে মেয়েদের কর্মজীবনের পথে বরাবরই বাধা সৃষ্টি করিয়াছে, হিন্দুত্বের রাজনীতির উত্থানের সহিত এই প্রবণতা আরও দৃঢ় হইয়াছে। একই সময়ে কর্মক্ষেত্র মেয়েদের জন্য আকর্ষণীয় হয় নাই, সুরক্ষিতও নহে। সংগঠিত এবং অসংগঠিত, উভয় ক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলার পারিশ্রমিকের বৈষম্য কমে নাই, বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাড়িয়াছে। রাষ্ট্র স্বয়ং এক বিপুল নারী বাহিনীকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টিবিধানের দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করিয়াছে, কিন্তু কর্মীর মর্যাদা দেয় নাই। ফলে মেয়েদের শ্রমের অবমূল্যায়ন বহাল রহিয়াছে।
তৎসহ, কর্মরত মহিলাদের জন্য রাস্তা ও পরিবহণ নিরাপদ করিবার যে অঙ্গীকার রাষ্ট্র করিয়াছিল ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পরে, তাহাও পূর্ণ করে নাই। নির্ভয়া তহবিলে বিপুল অর্থ বরাদ্দ হইয়াছে, কিন্তু খরচ হয় নাই। পথে এবং কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতি হিংসা ও অবমাননা অব্যাহত থাকিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী? আরও অধিক মহিলাকে কর্মক্ষেত্রে আনিবার পথ আজ সহজ নহে। মেয়েদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও হয়রানি রুখিতে কর্মক্ষেত্রে বিবিধ আইন ও বিধির যথাযথ রূপায়ণ, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মেয়েদের নিরাপত্তা ও সম্মানের নিশ্চয়তা, এর কোনওটিই সহজে হইবার নহে। কিন্তু প্রতিটিই সরকারের কর্তব্য। মেয়েরা আপন দক্ষতা ও পরিশ্রমেই বরাবর কাজ খুঁজিয়া লইয়াছে, সংরক্ষণের ভরসা করে নাই, তাহার দাবিও করে নাই। পথের বাধাগুলি দূর করিলেই যথেষ্ট, ভিক্ষার প্রয়োজন নাই।