খেলার বাঁধনে বাঁধা পড়িয়াছে গোটা বিশ্ব। এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লকডাউনে তাঁহার সঙ্গিনীর মনোরঞ্জন করিতে একটি খেলা বানাইয়াছিলেন— ইংরাজির পাঁচ বর্ণের শব্দ অনুমান করিবার খেলা। ছয় বার অনুমান করিবার সুযোগ— ভুল শব্দেও ঠিক অক্ষরটুকু থাকিলে কম্পিউটার বা মোবাইলের পর্দায় ঘরের রং বদলাইয়া তাহা জানা যাইবে। প্রতি দিন একটিমাত্র শব্দ— পরের শব্দের জন্য পরের দিন অবধি অপেক্ষা করা ভিন্ন উপায় নাই। খেলাটি গোড়ায় ব্যক্তিগত ছিল, তাহার পর প্রথমে বন্ধুবান্ধবের ঘনিষ্ঠ মহল, এবং তাহারও পর গোটা দুনিয়ার জন্য খুলিয়া দিয়াছেন খেলাটির উদ্ভাবক জোশ ওয়ার্ডল। তাহার কিছু দিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তার বিস্ফোরণ। প্রথমে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ইতিউতি উঁকি মারিতে লাগিল হলুদ-সবুজ রঙের খোপ। তাহার পর ইন্টারনেট ছাইয়া গেল অনুসরণকারী বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। তাহার পর মিলিয়ন ডলারের অধিক মূল্যে খেলাটিকে কিনিয়া লইল এক বৃহৎ সংবাদপত্র সংস্থা। খেলাটি প্রথম বার জনসমক্ষে আসিবার তিন মাসেরও কম সময়ে গোটা ঘটনাটি ঘটিয়া গেল। বাস্তবতুল্য গ্রাফিক-সমৃদ্ধ ভিডিয়ো গেম, অথবা অগমেন্টেড রিয়ালিটির খেলা ছাড়িয়া দুনিয়া এমন একটি সাদামাটা খেলায় মাতিল কেন, এই প্রশ্নটি স্বভাবতই উঠিতেছে। কিন্তু, তাহারও পূর্বে শোনা যাইতেছে একটি প্রশংসাবাণী— যে কোনও বিপণনেরই প্রথম কথা যেখানে নেশা ধরাইয়া দেওয়া, সেখানে এই খেলাটি কার্যত ধৈর্যের পরীক্ষা লয়। দিনে এক বারের বেশি খেলিবার উপায়মাত্র নাই। অর্থাৎ উপভোক্তাকে পরিমিতির গণ্ডি মানিতে বাধ্য করিবার ব্যবস্থা। সন্দেহ নাই, ব্যবস্থাটি দুনিয়াব্যাপী প্রশংসা অর্জন করিতেছে।
কিন্তু, দিনে এক বারের বেশি খেলিবার উপায় নাই, খেলাটির এই বৈশিষ্ট্য সম্ভবত তাহার জনপ্রিয়তার প্রকৃত কারণ নহে। তাহা হইলে আপাত অকিঞ্চিৎকর খেলাটি কেন এত দ্রুত ছড়াইয়া পড়িল? মনস্তত্ত্ববিদরা এই প্রশ্নের ত্রিমুখী উত্তর দিবেন। জনপ্রিয়তার প্রথম কারণ, খেলাটি সামাজিক। একা খেলিতে হয় বটে, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায়, মেসেজিং অ্যাপে অথবা ইমেলে যে হেতু অপরের সঙ্গে প্রাত্যহিক খেলার ফলাফল ভাগ করিয়া লওয়া যায়— বস্তুত, এই প্রাত্যহিক ফলাফল ঘোষণার প্রক্রিয়াটি ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর নিকট প্রথায় পরিণত হইয়াছে— ফলে, এই খেলাটি মূলত একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। কয়েকটি হলুদ-সবুজ-ধূসর খোপ প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক বন্ধনের সেতু হইয়াছে। দ্বিতীয় কারণ, এই খেলার ফলাফল হাতে গরম মেলে। এমনকি খেলা শেষ হইবারও প্রয়োজন নাই, প্রতিটি অনুমানের শেষে জানা যায়, কতগুলি বর্ণ ঠিক হইয়াছে। মনস্তত্ত্ববিদরা বলিবেন, তৎক্ষণাৎ ‘ফিডব্যাক’ মানুষকে খেলাটির দিকে প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করিতেছে। তৃতীয় কারণ হইল, এই খেলার বিষয় কাল্পনিক নহে— ইংরেজি শব্দভান্ডার। ফলে, তাহাতে জিতিলে নিজের দক্ষতার প্রতি আস্থা জন্মে। সেই আস্থা কম গুরুত্বপূর্ণ নহে।
অর্থাৎ, এক ভাবে দেখিলে এই খেলাটিকে উৎসাহীরা একটি প্রাত্যহিক পরীক্ষা হিসাবে দেখিতেছেন— যত দ্রুত দিনের শব্দটি অনুমান করিতে পারিতেছেন, পরীক্ষার নম্বর ততই ভাল। এবং, এইখানেই মানুষের মন তাহার সহিত একটি নিখাদ রসিকতা করিয়া চলিতেছে— যাহা বহুলাংশে ভাগ্য, তাহাকে ব্যক্তিগত দক্ষতা বলিয়া ভাবাইতেছে। ইংরেজি ভাষায় পাঁচ বর্ণের শব্দসংখ্যা কম-বেশি ১৫,০০০। যে হেতু প্রতি দিনই খেলাটি শুরু করিতে হয় সম্পূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে একটি শব্দ বাছিয়া লইয়া, ফলে সেই বাছাইটি দিনের শব্দের কতখানি কাছাকাছি হইবে, তাহা বিশুদ্ধ ভাগ্য বই আর কিছুই নহে। দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় ধাপে সমাধান করিতে পারিলেও তাহার পিছনে প্রথম শব্দটি বাছাইয়ের ভাগ্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু যাঁহারা খেলাটি খেলিতেছেন, তাঁহাদের অধিকাংশই ভাগ্যকে সাফল্যের কৃতিত্ব দিতে নারাজ হইবেন। কথাটি অবশ্য শুধু এই খেলাটির জন্য নহে, জীবনের সর্বত্রই সত্য— ব্যর্থতার জন্য মানুষ যত সহজে ভাগ্যকে দায়ী করে, সাফল্যের কৃতিত্ব ভাগ্যকে দিতে তেমন রাজি হয় না। আলোচ্য খেলাটি মানব মনের এই ধর্মকে নিজের স্বার্থে চমৎকার ব্যবহার করিয়াছে। সাফল্যের পিছনে নিজের সামর্থ্যকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ নিজের প্রকৃত মাপটি বুঝিতে পারে না, তাহা ঠিক— কিন্তু, নিজের ক্ষমতার প্রতি এই আদ্যন্ত বিশ্বাসই মানুষকে অনেক গিরিলঙ্ঘনে সাহায্য করিয়াছে, তাহাও অনস্বীকার্য।