ভারতে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বহু সময়েই কেবল শোভনতার সীমা অতিক্রম করে না, সভ্যতার সীমা অতিক্রমেরও বড় কাছাকাছি চলিয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় গত কয়েক দিন ধরিয়া যে কুনাট্যরঙ্গ অনুষ্ঠিত হইতেছে, তাহা এই ভাবেই শোভন কিংবা সভ্য বিশেষণের সীমা ছাড়াইবার জোগাড়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আইনসভায় তথ্য এবং যুক্তি সহযোগে আইন প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা করিবেন, তৎসহ রাজ্যের সর্বজনীন মঙ্গলের জন্য কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে তর্কবিতর্কের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাইবেন— এমন প্রত্যাশার কোনও অর্থই আর অবশিষ্ট নাই, কিন্তু অন্তত তাঁহাদের আচরণে স্বাভাবিক সৌজন্যটুকুও থাকিবে না? দিনের পর দিন বিধানসভায় কখনও ইঁহারা উঁহাদের দিকে ধাবিত হইতেছেন, হুমকি দিতেছেন, ওয়েলে নামিয়া স্লোগান সহকারে হুলস্থুল বাধাইতেছেন। কখনও উঁহারা ব্যাঘ্র-বিক্রম দেখাইয়া তর্জন করিতেছেন, হাত ছুড়িয়া অশোভন ভঙ্গিতে বিবিধ কটূক্তি করিতেছেন। পরস্পরের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ উদ্গীর্ণ হইতেছে অকাতরে। এই অসহনীয় কুনাট্যের শরিক হইতেছেন শাসক এবং বিরোধী দুই পক্ষই।
মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয়ও এই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সমধিক দায়ী। তিনি যে ভাবে দীর্ঘ দিন যাবৎ একাদিক্রমে অসহযোগিতা করিয়া অশোভনতার সীমা ছাড়াইয়াছেন, তাহাতে পরিস্থিতি ক্রমশ বিষায়িত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। নিন্দকে বলিবেন, বিষায়িত করাই যখন উদ্দেশ্য ছিল, তিনি এবং তাঁহারা সফল হইয়াছেন, এমনই বলা ভাল। তিনি যখন অভিযোগ করেন যে তাঁহাকে শারীরিক ও মৌখিক ভাবে বাধাদান করা হইয়াছে, তখনও কিন্তু এমনই সংশয় জাগিতে পারে যে, সঙ্কট মিটানো তাঁহার উদ্দেশ্য নহে, বরং স্বল্পছিদ্রপথে বৃহৎ শনি প্রবেশ করানোই গূঢ় লক্ষ্য। নতুবা কোনও রাজ্যপাল নিজেকে কেন এই জায়গায় লইয়া যাইবেন যেখানে মুখ্যমন্ত্রীকে আসিয়া করজোড়ে দাঁড়াইয়া অনুনয় করিতে হয়, এবং তাহাতেও সঙ্কটের মোচন হয় না? রাজ্যপালের মূল ভূমিকাটি আলঙ্কারিক, যে অলঙ্কারের প্রধান লক্ষ্য প্রশাসনিক সৌষ্ঠব রক্ষা। রাজ্যপাল ধনখড় কি সেই লক্ষ্য আদৌ মাথায় রাখিয়াছেন? দেশের অন্যত্র কী হইতেছে বা হইয়া থাকে, সেই তুলনা টানিবার বিশেষ স্পৃহা বা প্রয়োজন কোনওটিই না রাখিয়া বলা যাইতে পারে— পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় রাজনীতি অধুনা যেন কেবল ক্ষমতা প্রদর্শনের দড়ি টানাটানিতে পর্যবসিত। গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনার পরিবেশ নির্মাণে যেটুকু ন্যূনতম সদিচ্ছা এবং শোভন ব্যবহারবিধি লাগে, তাহা এই কার্যক্রম হইতে সম্পূর্ণ উধাও।
নিরুদ্দেশকে ফিরাইয়া আনিবার আশাও বিশেষ নাই, কেননা শাসক দলের আচরণেও তেমন সদিচ্ছার আত্যন্তিক অভাবই প্রকট। বড় সংখ্যায় জিতিয়া আসা এক কথা, এবং সেই সাফল্য দর্শাইয়া ক্রমাগত বিরোধীকে বিদ্রুপ এবং ক্ষুদ্র করা আর এক কথা। অথচ তাহাই ঘটিতেছে অনবরত। সত্যের খাতিরে, ইহা কেবল বর্তমান শাসকের বৈশিষ্ট্য বলা যাইবে না। অতীতে বিপুল অহঙ্কারে ‘আমরা এত উহারা অত’ আস্ফালন শুনাইয়াছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, যাঁহার দল এখন বিরোধী হইয়াও আসনাভাবে বিধানসভায় অনুপস্থিত। আর সেই সময়ে যাঁহারা বিরোধী স্থানে থাকিয়া এমত কটুভাষণে আহত বোধ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নেত্রীই এখন ‘যাহারা জিতিতে পারে না তাহারা বড় বড় কথা বলে’ বাক্য উচ্চারণ করিতেছেন। গৌরবান্বিত হইবার মতো বিষয় নহে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর অশেষ দুর্ভাগ্য, একের পর এক দল আসে, শাসক আসেন— আর রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির নূতন নূতন দৃষ্টান্তে নাগরিককে লজ্জাজর্জরিত বোধ করিতে হয়। বঙ্গীয় রাজনীতির এই উৎকট চেহারা রোধ করিতে যে ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য ও শুভবোধ প্রয়োজন, বর্তমান শাসক বা বিরোধী কাহারও তাহা নাই।