বগটুই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ঘোষণাটি তাৎপর্যপূর্ণ বলতে হবে। তিনি দুর্নীতি-জুলুম রোধের কথা বলেছেন, খুন-অত্যাচার ইত্যাদির দিকে নির্দেশ করে স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। মুশকিল হল, রামপুরহাট অঞ্চলের ভয়াবহ নৃশংসতার প্রেক্ষিতে এই ঘোষণার কার্যকারিতা কতখানি, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এত দিনে পরিষ্কার যে, পরিস্থিতি সামলানোর বন্দোবস্ত যদি করতে হয়, প্রশাসনিক স্তর থেকেই তা আসতে হবে, এবং প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে সে কাজে তাঁকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। দলের তরফেই হোক, আর সরকারের তরফেই হোক— দায়ভাগ বর্তায় তাঁর উপরেই। কী ভাবে সে দায়িত্ব তিনি পালন করবেন, কোন পদ্ধতিতে দায়িত্ব বণ্টন করবেন, সেটাও তাঁকেই ভাবতে হবে। কেবল জনসভায় প্রবলভাষণে উষ্মা প্রকাশ করে সেই কর্তব্য সমাধা করা যাবে না। নিজের বিরুদ্ধে নিজে সতর্কবার্তা দেওয়া যায় না। সুতরাং, তাঁকে কাজ করে দেখাতে হবে যে তিনি কাজ করলেন। তাঁর দলের নীচের স্তরে দুর্নীতি ও বখড়া-বণ্টনের খেয়োখেয়ি বিস্ফোরক আকার ধারণ করেছে, শান্তিরক্ষায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং সংঘর্ষ বৃদ্ধিতে পুলিশি মদত এখন দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হয়েছে। এ সবের সমাধান উচ্চ নেতৃত্ব ছাড়া কে-ই বা করতে পারেন? রাজ্যবাসী নিশ্চয় জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া পদক্ষেপ করলেই একমাত্র কিছু পরিবর্তনের আশা। কেবল কড়া হুমকি ও তীব্র ভাষণে কাজের কাজ হবে না।
সম্ভবত এই উদ্বেগ থেকেই মুখ্যমন্ত্রী ‘দিদিকে বলো ২’ দাওয়াই-এর প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু এখানেও গুরুতর প্রশ্ন। মুখ্যমন্ত্রীকে দায়িত্বটি নিতে হবে, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, তিনি একাই সমগ্র রাজ্যে শতভুজা ও শতাক্ষী হয়ে ছড়িয়ে থাকতে পারবেন! ‘দিদি’র প্রতি অনেক নাগরিকের হয়তো এখনও অনেক ভরসা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে এমন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতেই হবে, যাতে কোনও ‘ব্যক্তি’র পরিবর্তে ‘ব্যবস্থা’র প্রতি মানুষ ভরসা রাখতে পারেন। পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, পঞ্চায়েত— গণতন্ত্রে এই স্তরগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ এই জন্যেই, যে তারা ছড়িয়ে থাকে সমাজের গভীরে, প্রত্যন্তে। সেগুলি ছাড়া কোনও ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবেন না। তাঁকে এখন নিজ ব্যক্তিত্বের বাইরে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর নেতৃত্বের পরিচয় দিতে হবে— প্রশাসনিক কাঠামোকে শক্ত করতে হবে, কোনও রকম দলীয় সঙ্কীর্ণতা বা সংঘাতকে প্রশ্রয় না দিয়ে যেন সেই কাঠামো লৌহকঠিন দৃঢ়তায় কাজ করে, তা দেখতে হবে। অসম্ভব কঠিন কাজ, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সাধারণ নেত্রী নন। তিনি বহু দুরূহ পরিস্থিতি সামলেছেন। আজ আবার তাঁর সামনে এক কঠিন পরীক্ষা। রাজনীতিক হিসাবে নয়— প্রশাসক হিসাবে।
দুর্নীতির প্রশ্নে কড়া অবস্থান নিতে হলে অবশ্য এও স্পষ্ট করতে হবে, কোন তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে মুখ্যমন্ত্রী ডেউচা পাঁচামির আন্দোলনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করছেন। যদি প্রমাণ কিছু থাকে, তা হলে যথাযোগ্য ব্যবস্থা করার দাবি রইল। কিন্তু সঙ্গে এও দাবি করা যেতে পারে যে, প্রমাণ ব্যতিরেকে অভিযোগ তোলার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নিদর্শন যেন কোনও নেতা বা নেত্রী স্থাপন না করেন। যে ঘটনা ঘটেছে, তা এতই মর্মান্তিক এবং ভয়ঙ্কর যে, সমগ্র রাজ্যের সকল শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক এখনও নিরপেক্ষ তদন্তের আশা করছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন অভিযোগও তুলেছেন যে রামপুরহাট নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সিবিআই-কে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছে। তিনি যদি চান, অভিযোগটি সত্যিই জনচিত্তে গুরুত্ব সহকারে প্রবেশ করুক, তা হলে কিন্তু সর্বাগ্রে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁর নিজের রাজ্যের পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাববিহীন ভাবেই তাদের কাজ করে!