যক্ষ যে প্রশ্নই করিলেন, যুধিষ্ঠির তাহার যথাযথ উত্তর দিলেন। মহাভারতের যুগে গণতন্ত্র ছিল না, ভোটও ছিল না— ফলে, মোক্ষমতম প্রশ্নটি যক্ষের মাথায় আসে নাই। তিনি যদি প্রশ্ন করিতেন যে, মানুষ কী দেখিয়া ভোট দেয়, ধর্মপুত্রের নিকটও সম্ভবত তাহার জবাব থাকিত না। ফলে, উত্তরপ্রদেশে কী ঘটিতেছে, তাহা আন্দাজ করা অসম্ভব। তবে, গণতন্ত্রের গবেষণাগারে ২০২২ সালের উত্তরপ্রদেশ একটি বিশিষ্ট আসনের দাবিদার। গত পাঁচ বৎসরে এই রাজ্যে কী কী হইয়াছে, চুম্বকে সেই হিসাবটি এই রকম— অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস হইয়াছে, বারাণসীতে বিশ্বনাথ মন্দিরের সংস্কার হইয়াছে, গোহত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে, ভিন্নধর্মে বিবাহের পথে প্রবল সরকারি বাধা তৈরি হইয়াছে। অন্য দিকে, রাজ্য মাথাপিছু আয়ের নিরিখে উত্তরপ্রদেশ দেশের ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ৩৩তম, রাজ্যে মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের অর্ধেক। পূর্বতন সরকারের পাঁচ বৎসরে, ২০১২ হইতে ২০১৭ সালের মধ্যে, রাজ্যের বাৎসরিক আয়বৃদ্ধির হার প্রায় সাত শতাংশ ছিল— যোগী আদিত্যনাথের আমলে তাহা কমিয়া দুই শতাংশেরও কমে দাঁড়াইয়াছে। তাহার খানিক দায় অতিমারির, কিন্তু সেই ধাক্কা লাগিবার পূর্বেই উত্তরপ্রদেশের আয়বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হইয়াছিল। তবে, ভয়ঙ্করতম অবস্থা কর্মসংস্থানের। রাজ্যে প্রতি দুই জন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষিত নাগরিকের মধ্যে এক জন কর্মহীন। যোগী আদিত্যনাথ যতই অর্থনৈতিক উন্নতির রূপকথা শুনাইবার চেষ্টা করুন, বাস্তব ভয়াবহ।
গণতন্ত্রের গবেষণাগারে উত্তরপ্রদেশের গুরুত্ব হইল, এই রাজ্যের বর্তমান নির্বাচনের ফলাফল ইঙ্গিত করিবে যে, মানুষের মন কোন ঘটনাতে কতখানি গুরুত্ব দেয়। মনের নিকট যদি হিন্দু উচ্চবর্ণ শাসিত এক প্রবল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্ব সর্বাধিক হয়, তবে যোগী আদিত্যনাথের সরকারকে দুই হাত ভরিয়া আশীর্বাদ না করিবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। এই আমলে মুসলমান পিটাইলেও সচরাচর শাস্তি হয় নাই; উন্নাও বা হাথরস সাক্ষ্য দিবে যে, ধর্ষণ করিলেও নহে। মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী, এই রাজ্যের মাটিতে মুসলমান-বিদ্বেষী কথা বলিতে কেহ আর রাখঢাকও করেন না। নিম্নবর্গের মানুষের উপর অত্যাচারের অন্যান্য ঘটনাও আলো-বাতাসের ন্যায় স্বাভাবিক হইয়াছে। অন্য দিকে, চাকুরি নাই, আয় নাই, শিক্ষার যথেষ্ট সুযোগ নাই, স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল তথৈবচ— ভারতের সর্বাপেক্ষা পিছাইয়া পড়া রাজ্যগুলির অন্যতম উত্তরপ্রদেশ। অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য যদি ভোটারের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে এই সরকারকে সমর্থন করা মুশকিল। কেহ বলিতে পারেন, অসম্ভব।
এই নির্বাচনে ভোটারের মন কোন দিকে ঝুঁকিয়া থাকিল, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলিতে আরও এক সপ্তাহ। কিন্তু প্রশ্নটি নূতন নহে, ভারতীয় ভোটদাতারাও এই প্রথম এ-হেন প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন না। দুর্ভাগ্য, ইতিপূর্বে প্রায় কখনও ভোটারের মনে অর্থব্যবস্থার গুরুত্বের প্রমাণ মিলে নাই। দেশেও নহে, এই রাজ্যেও নহে। ২০০৪ সালে যে নির্বাচনে অটলবিহারী বাজপেয়ী হারিলেন, সেখানে তাঁহারা ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর আখ্যান বেচিতেছিলেন। আবার, ২০১৪ সালে দেশবাসীর রায়ে যে ইউপিএ সরকার বিদায় হইল, তাহার দশ বৎসরের সিংহভাগ ছিল ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উজ্জ্বলতম সময়। উত্তরপ্রদেশেও যোগী আদিত্যনাথের সরকারের তুলনায় অখিলেশ যাদব, এবং মায়াবতীর আমলে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য উন্নততর ছিল। ভোটের ফলাফলে সেই উন্নতির ছায়া পড়ে নাই। এখানেই ভোটারের দায়িত্ব। তাঁহাদের ভোট যদি অর্থব্যবস্থাকে এতখানি গুরুত্বহীন বলিয়া ঘোষণা করিয়া দেয়, স্বভাবতই তাহা নেতাদের নিকটও গুরুত্বহীনই হইবে। তাহার পর কি আর চাকুরি নাই বলিয়া উদ্বেল হওয়া চলে?