ভারতের শিশুদের কোভিড অতিমারি কতখানি বিপন্ন করিয়াছে, তাহাদের ভবিষ্যৎ কত দূর অনিশ্চিত হইয়াছে, তাহা এখনও যথাযথ নির্ণয় হয় নাই। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র জানাইয়াছে, ভারতে অনাথ শিশুর সংখ্যা অন্তত ১৯ লক্ষ, যাহা ভারতের সরকারি পরিসংখ্যানের বারোগুণ। গবেষকরা একটি গাণিতিক ‘মডেল’ ব্যবহার করিয়া বিশ্বের সকল দেশে কোভিড-মৃত্যুহার হইতে অনাথ শিশুদের সংখ্যা গণনা করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে বিশ্বের সকল দেশ মিলাইয়া অন্তত বাহান্ন লক্ষ শিশু অনাথ হইয়াছে, তাহাদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ভারতে। অথচ, সরকারি তথ্য অনুসারে, পিতা-মাতার কোনও এক জন, অথবা উভয়কেই হারাইয়া অভিভাবকহীন হইয়াছে, এমন শিশুর সংখ্যা দেড় লক্ষেরও কম। জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন এই বৎসর ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে জানাইয়াছে, কোভিডের প্রথম কুড়ি মাসে ১ লক্ষ ৪২ হাজার শিশু অনাথ হইয়াছে। কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক সংসদে জানাইয়াছে, অনাথ শিশুর ভাতা পাইবার জন্য বিভিন্ন রাজ্য হইতে ৬৬২৪টি নাম জমা পড়িয়াছিল— ৩৮৫৫টি অনুমোদন পাইয়াছে। এই শিশুদের পরিচর্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবার অথবা প্রতিষ্ঠান ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল হইতে মাসে দুই হাজার টাকা অনুদান পাইবে, প্রাপ্তবয়স্ক হইলে তাহারা দশ লক্ষ টাকা পাইবে। কিন্তু গোল বাধিয়াছে শিশুদের সংখ্যায়। কোথায় উনিশ লক্ষ, কোথায় তিন হাজার! এই গতিতে শিশুদের নাম অনুমোদন করিবার পালা চলিলে অধিকাংশ শিশুরই শৈশব সহায়তাহীন কাটিয়া যাইবে, সন্দেহ নাই।
সংখ্যার এই বিপুল বৈষম্যের মূলে রহিয়াছে মৃত্যুহার লইয়া সংশয়। ভারত সরকার কোভিডে মৃত্যুর যে হার স্বীকার করিয়াছে, অনেক বিজ্ঞানী অন্যান্য সূত্র হইতে, অথবা নিজেদের সমীক্ষা হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাহার আট-দশগুণ অধিক মৃত্যুহারের দাবি করিয়াছেন। কিন্তু তাহা সংখ্যাতত্ত্বের বিতর্ক। অনাথ শিশুদের যথাযথ চিহ্নিতকরণ, সহায়তা দান ও তত্ত্বাবধানের বিষয়ে বাদানুবাদের অবকাশ নাই। কিন্তু সে কাজ করিবে কে? সারা বিশ্বই এই সমস্যার সম্মুখীন— দশ বৎসরে এইচআইভি-এডস বিশ্বের যত শিশুকে অনাথ করিয়াছিল, মাত্র দুই বৎসরে তাহা করিয়াছে কোভিড অতিমারি। কর্মক্ষম পিতামাতার মৃত্যু হইয়াছে, অতএব শিশুর প্রতিপালনের দায় রাষ্ট্রের উপরেই বর্তাইয়াছে। কোন দেশের সরকার কতটা প্রস্তুত, সে প্রশ্নটি আজ বড় হইয়া উঠিয়াছে।
ভারতের সমস্যা প্রধানত দুইটি— রাজনৈতিক দলগুলির সত্যগোপনের প্রবণতা, এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা। সরকারপক্ষ বিরোধীর সমালোচনা এড়াইতে কোভিডের মৃত্যুহার কম দেখাইবে, ফলে অনাথের সংখ্যাও দেখাইবে যৎসামান্য, তাহার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অপর দিকে, লক্ষাধিক অনাথ শিশু চিহ্নিত হইলেও এক বৎসরে মাত্র হাজার তিনেক সরকারি ভাবে তহবিল হইতে সহায়তার অনুমোদন পাইয়াছে। এই গয়ংগচ্ছ মনোভাব এই ক্ষেত্রে অপরাধ। বহু অনাথ শিশু সরকারি পরিসংখ্যানের বাহিরে রহিয়াছে, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ মিলিয়াছে। অতএব অতি সত্বর পঞ্চায়েত-পুরসভা স্তরে বিশেষ সমীক্ষা চালাইয়া অভিভাবকহীন শিশুদের চিহ্নিত করিতে হইবে। তাহাদের যথাযথ সহায়তা ও তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করিতে হইবে রাজ্য ও কেন্দ্রকে।