হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিবার কৃতিত্বে ভূভারতে পশ্চিমবঙ্গের জুড়ি নাই। অর্থনীতিকে তাহার বদ্ধদশা হইতে উদ্ধার করিয়া উন্নয়নের পথে চালিত করিবার সমস্ত সুযোগ এবং সম্ভাবনাকে প্রতিহত করিয়া অচলাবস্থাকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করিয়াছে এই রাজ্যটি। গত শতাব্দীর ষাটের দশক হইতে সেই নেতির সাধনা চলিতেছে, আজও তাহার বিরাম নাই। জনদরদের নামে উন্নয়নের পথে বাদ সাধিয়া যাঁহারা ক্ষমতায় বহাল থাকেন অথবা ক্ষমতা অর্জন করেন, তাঁহাদের বোধোদয় হইলেও নিস্তার নাই, বিরোধী রাজনীতি গণতন্ত্রের ব্যবস্থাটিকে কাজে লাগাইয়া তাঁহাদের প্রবল বেগে পিছনে টানিতে থাকেন। দীর্ঘ দিনের বামপন্থী মোহজাল ছিন্ন করিয়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের চেষ্টা শুরু করেন, সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং বিরোধী রাজনীতি দল বাঁধিয়া সেই চেষ্টা পণ্ড করিতে ময়দানে অবতীর্ণ হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের অনুকূল জলহাওয়ায় সেই অভিযান অচিরে সফল হয়, শিল্প-সম্ভাবনা অস্তমিত হয়। আবার, সেই নেতিবাচক রাজনীতির পিঠে সওয়ার হইয়া ক্ষমতা লাভ করিবার এক দশক পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন উন্নয়নের বৃহৎ উদ্যোগে নামিতে আগ্রহী হইয়াছেন, তৎক্ষণাৎ তাঁহার শুভবুদ্ধি এবং অগ্রবর্তিতাকে বানচাল করিতে তৎপর হইয়াছে পশ্চিমবঙ্গের নেতিবাদ। ডেউচা-পাঁচামির সম্ভাবনাময় কয়লা খনি প্রকল্পকে স্তব্ধ করিতে অপপ্রয়াস চলিতেছে।
অথচ, মানিতেই হইবে, এই প্রকল্প রূপায়ণের জন্য মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার সরকার সামগ্রিক পরিকল্পনা করিয়াই কাজে নামিয়াছেন, বিশেষত প্রকল্পের ফলে যে স্থানীয় অধিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন তাঁহাদের জন্য ক্ষতিপূরণের বিশদ আয়োজন হইয়াছে। শুধু তাহা নহে, বিরোধিতা ও দাবিদাওয়ার সম্মুখীন হইয়া সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং পরিমাণ বাড়াইতেও সম্মত হইয়াছে এবং সেই মর্মে সংশোধিত প্রস্তাবও ঘোষণা করিয়াছে। উন্নয়নের সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি সামলাইবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসাবে এই পরিকল্পনা এবং সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক আলোচনার পথেই তাহা ঘটিয়াছে, ভবিষ্যতেও ঘটিতে পারে। কিন্তু যাঁহারা প্রকল্পটিকেই বানচাল করিতে তৎপর, তাঁহারা গণতন্ত্রকে আপন অচলাবস্থার রাজনীতির প্রকরণ হিসাবে ব্যবহার করিতে চাহেন, রাজ্যের উন্নয়ন লইয়া তাঁহাদের মাথাব্যথা নাই। লক্ষণীয়, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অধিবাসীদের একাংশ বাস্তববুদ্ধির প্রেরণায় ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করিয়া প্রকল্পের পথ ছাড়িয়া দিতে সম্মত, কিন্তু অন্য একটি অংশকে বিভ্রান্ত করিয়া বাধা সৃষ্টি করিবার কাজ চলিতেছে এবং সেই কাজে ইন্ধন জোগাইতেছেন বহিরাগত রাজনীতির কারবারিরা।
শেষ অবধি ইহাতে সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের লোকসান, বিশেষ ভাবে লোকসান স্থানীয় অধিবাসীদের। খনি প্রকল্পটি দ্রুত রূপায়িত হইলে এবং তাহার আকর্ষণে বৃহত্তর শিল্পায়ন ঘটিলে তাঁহাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হইত। বস্তুত, সদর্থক এবং উন্নয়ন-বান্ধব বিরোধী রাজনীতির কাজ হইতে পারিত সেই শিল্পায়নের সুফল যাহাতে ক্ষতিপূরণের অংশ হইয়া উঠিতে পারে তাহার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। অর্থাৎ, খনি হইতে এবং স্থানীয় শিল্পের প্রসার হইতে যে সম্পদ সৃষ্টি হইবে তাহার একটি অংশ ভবিষ্যতে স্থানীয় উন্নয়নের কাজে লাগাইবার দাবি জানানো। তাহা হইত ক্ষতিপূরণের উন্নয়নমুখী ধারণার ভিত্তিতে পরিচালিত সদর্থক গণতন্ত্রের রাজনীতি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সেই সৌভাগ্য কোনও দিন ছিল না, আজও নাই। মাটির নীচে সম্পদের ভান্ডার মিলিলেও স্বাভাবিক ভাবে তাহার সদ্ব্যবহার করিবার উপায় নাই, ‘চলিবে না’-পন্থীরা রে রে করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িবেন। ইহাই বোধ করি এই রাজ্যের বিধিলিপি।