সাহিত্যপিপাসুরা জানিতেন, কবিবর বাণভট্টের কল্পনা মুক্তহস্ত, অস্থানে-অপাত্রেও তিনি অজস্র বর্ষণ করিয়া থাকেন। রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, তাঁহার অকৃপণতা কেবল রাজদুহতার প্রতি, সহচরীর নিমিত্ত এক বিন্দু অভিষেকবারিও সিঞ্চিত হয় নাই। ভোট-পূর্ববর্তী কালে ভারতীয় জনতা যখন প্রতিশ্রুতির প্লাবনে ভাসিয়া যান, তখন পরিযায়ী শ্রমিকগণের দুর্দশা নিবারণে সামান্যতম অঙ্গীকারও কি কর্ণগোচর হয়? সংসদীয় রাজনীতির নজর তো নাই, তাঁহাদের নাই ট্রেড ইউনিয়নও। তাঁহারা স্বল্পমূল্যে ভিন্রাজ্যে খাটিতে যান। কর্মভূমিতে তাঁহাদের ভোট নাই, তদুপরি তাঁহাদের কারণে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজ হারাইবার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে স্থানীয় কর্মী ও নেতারা তাঁহাদের উপর প্রবল ক্ষুব্ধ, পরিযায়ীদেরও নিজেদের কথা শুনাইবার সুযোগ নাই। এমতাবস্থায়, কর্নাটকে বসবাসকারী পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকেরা বেঙ্গালুরুতে যে সংগঠিত বৈঠকের আয়োজন করিলেন, তাহা তাৎপর্যপূর্ণ। সংগঠিত হওয়া জরুরি, কারণ পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের অমোঘ চরিত্র হইল, তাঁহারা অসংগঠিত শ্রমিক। এমনকি, সংগঠিত ক্ষেত্রের কাজেও তাঁহারা অসংগঠিত শ্রমিক হিসাবেই থাকিয়া যান। ফলে, শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রের কৃপণ বামমুষ্টি গলিয়া যতটুকু সুযোগসুবিধা এখনও নির্গত হয়, পরিযায়ী শ্রমিকরা তাহা হইতেও বঞ্চিত থাকিয়া যান। ফলে, যে কোনও ভাবেই হউক, তাঁহারা সংগঠিত হইয়া, কৌম পরিচিতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিকট, সমাজের নিকট নিজেদের দাবি পেশ করিতে পারিলে তবেই তাঁহাদের কণ্ঠস্বর শ্রুত হইবার সম্ভাবনা।
অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকের যে অনিশ্চয়তা, পরিযায়ী শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা তাহারও অধিক। কারণ, তাঁহারা নিজভূম হইতে বিচ্ছিন্ন। কর্মসূত্রে তাঁহারা যে অঞ্চলের বাসিন্দা, সেখানে তাঁহাদের শিকড় নাই— ফলে, সেই সমাজ তাঁহাদের ব্রাত্য করিয়া রাখে। নিজভূমে নাগরিকের যেটুকু জোর থাকে, পরিযায়ীদের তাহাও নাই। সমাজে যাঁহারা ‘অপর’, তাঁহারা যেমন প্রায়শই মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত, তেমনই তাঁহাদের স্কন্ধে অপরাধের কলঙ্ক চাপাইয়া দেওয়াও সহজ। এক কাগজকুড়ানি জানাইয়াছেন— কন্নড় বা হিন্দি না জানিবার কারণে পুলিশ ‘বাংলাদেশি’ বলিয়া টাকা আদায় করে, নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র দেখাইলেও হুমকি দেয়। সন্তানাদির লেখাপড়ার সুযোগও নাই— বিবিধ রাজ্য হইতে আগত জনতার মাতৃভাষার মাধ্যমে বিদ্যালয়ের বন্দোবস্ত অনুপস্থিত। প্রশাসনও তাঁহাদের দায় লইতে প্রায়শই অস্বীকার করে— নিজভূমের, এবং পরভূমের, উভয় প্রশাসনই।
প্রশ্নটি, অতএব, রাজনৈতিক। যাঁহাদের ভোট নাই, অর্থাৎ যে অংশের মতামতে রাজনীতিকের উত্থান-পতন নির্ভর করে না, তাঁহাদের কথা শুনিবার দায়ও নাই। সুস্থ নাগরিকের ন্যায় পরিযায়ীদের বাঁচিবার অধিকার সুনিশ্চিত করিতে হইলে কর্মস্থলে ভোটদানের অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত পথ নাই। নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করিবার, এবং তাহা আদায় করিবার একটিমাত্র পথ সম্ভব— যে পরিচিতির ভিত্তিতে বঞ্চনা, তাহােক কেন্দ্র করিয়াই কৌম পরিচিতি গড়িয়া তোলা, যৌথ ভাবে দাবি পেশ করা। সংগঠিত হইবার প্রচেষ্টা সেই রাজনীতির প্রথম ধাপ হইতে পারে।