সুখ ও দুঃখকে সমদৃষ্টিতে দেখিবার কঠিন কাজটি কি তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়ত্ত করিয়া ফেলিল? না হইলে সন্তানশোক তাহাকে স্পর্শ করে না কেন? উত্তরবঙ্গে ১৩ সেপ্টেম্বর হইতে তিপ্পান্ন জন শিশুর মৃত্যুতে সরকার অবিচল। রাজ্যবাসী কেবল জানিয়াছেন, ওই সকল শিশুর মৃত্যু কোনও একটি কারণে ঘটে নাই, এমনকি নিউমোনিয়া-আক্রান্ত শিশুরাও জ্বর কিংবা শ্বাসকষ্টে মরে নাই। এমন অবান্তর এবং অসার ব্যাখ্যা শুনিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কর্তব্যবোধ ও মানবিকতা লইয়া সন্দেহ জাগে। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আগত শিশুর মৃত্যু যেন নিতান্ত স্বাভাবিক, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার কোনও প্রয়োজন নাই, প্রশ্ন তোলাও অকারণ, এমনই ভাব স্বাস্থ্য দফতরের। কিন্তু প্রশ্ন উঠিবেই। পর পর এতগুলি শিশুর মৃত্যুর পশ্চাতে যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নাই, সে বিষয়ে কী প্রকারে নিশ্চিত হইল সরকার? তাহার যথাবিহিত অনুসন্ধান কি হইয়াছে? সাধারণ জ্ঞানেই ইহা বোঝা সম্ভব যে, মৃত্যুর কারণ কেবল ভাইরাস কিংবা জীবাণু নহে। চিকিৎসাব্যবস্থার পরিকাঠামো, ঔষধ-সহ নানা উপকরণের জোগান, শিশুর আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা, এই সকলই তাহাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলিয়া দেয়। ভাইরাস বহু শিশুকেই আশ্রয় করে— কিন্তু যাহারা দুর্বল, অপুষ্ট, যথাসময়ে ঔষধ ও চিকিৎসা হইতে বঞ্চিত, তাহাদেরই অকালমৃত্যু ঘটে। এই সকল কারণ তিপ্পান্ন জন শিশুর কত জনের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী হইয়া উঠিয়াছে, তাহাদের প্রত্যেকের মৃত্যু অনিবার্য ছিল কি না, তাহা নির্ধারণ করিবে কে?
শিশুমৃত্যুর ধারাবাহিক সংবাদে বার বার কয়েকটি অঞ্চলের নাম উঠিয়া আসিয়াছে। কোচবিহারের হলদিবাড়ি, শিলিগুড়ির মাটিগাড়া, জলপাইগুড়ির মালবাজার, ময়নাগুড়ি, নাগরাকাটা, উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর অঞ্চলগুলি হইতে আগত মা ও শিশুরা বিশেষ ভাবে বিপন্ন, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ-সহ নানা হাসপাতালের তথ্য হইতে তাহার আভাস মেলে। এই এলাকাগুলি দরিদ্র, অকালমৃত শিশুদের পরিবার চা বাগানে, নদীখাত হইতে পাথর আহরণে, খেতমজুরিতে নিযুক্ত। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অপুষ্ট প্রসূতির স্বল্প ওজনের নবজাতক বাঁচে নাই। ইহাতে অপুষ্টির তীব্রতার একটি ইঙ্গিত মেলে। তাই ওই সকল অঞ্চলে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প, মিড-ডে মিল, রেশনব্যবস্থা প্রভৃতি কতটা সক্রিয়, তাহা শিশুদের প্রয়োজন কতটা মিটাইতেছে, দেখা প্রয়োজন। চিকিৎসা পরিকাঠামোর ঘাটতিও কি নাই? চিকিৎসকদের দাবি, হাসপাতালে আনিতে বিলম্ব মৃত্যুর অন্যতম কারণ। প্রশ্ন উঠিবে, ওই অঞ্চলগুলিতে প্রাথমিক ও ব্লক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওই শিশুদের কী চিকিৎসা হইয়াছিল? দূরের হাসপাতালে ‘রেফার’ করিতে হইল কেন, পরিবহণের কী ব্যবস্থা হইয়াছিল, সে তথ্যও মেলে নাই।
দরিদ্রের যাবতীয় সঙ্কটের দায় দরিদ্রের উপরেই চাপাইবার সুপরিচিত কৌশলটি এই ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করিবার চেষ্টা চলিতেছে, বিলম্বের জন্য পরিবারকে দায়ী করিয়া। শিশুর অভিভাবক কতটা ‘সচেতন,’ তাহার বিচার না করিয়া সরকারি চিকিৎসক ও আধিকারিকরা আপন কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হউন। উত্তরবঙ্গে শিশুমৃত্যুগুলিকে সরকার ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহে, কিন্তু তাহা বস্তুত স্বাস্থ্যব্যবস্থার গভীর অসুখের বহিঃপ্রকাশ। প্রথমত, ‘স্বাস্থ্যসাথী’ বিমা প্রকল্প অনুন্নত জেলাগুলির দরিদ্র পরিবারের নিকট দ্রুত ও কার্যকর চিকিৎসা নিশ্চিত করিতে পারে নাই। দ্বিতীয়ত, মা ও শিশুর অপুষ্টি আজও শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ, বিবিধ খাদ্য বিতরণ প্রকল্প সত্ত্বেও তাহার প্রকোপ কমিবার লক্ষণ নাই। তৃতীয়ত, সরকারি আধিকারিকরা সরকারকে বাঁচাইতে যত তৎপর, শিশুর প্রাণ বাঁচাইতে অত নহে। ইহার প্রতিটিই রাজনীতি ও প্রশাসনে গভীর অসুখের লক্ষণ।