চতুর্থ ঢেউয়ের পদধ্বনি? বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে ভাবে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যায় ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে ভারতের ক্ষেত্রে এমন অনুমান অসঙ্গত নয়। ইতিমধ্যেই করোনার নতুন স্ফীতিতে বিপর্যস্ত চিন এবং দক্ষিণ কোরিয়া। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় এক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা পেরিয়েছিল ছ’লক্ষের গণ্ডি। অন্য দিকে, গোড়া থেকেই ‘কোভিড-শূন্য’ নীতি নিয়ে চলা চিনেও দৈনিক সংক্রমণ যথেষ্ট বেড়েছে। ফের লকডাউনের পথে হাঁটতে হয়েছে প্রশাসনকে। জার্মানি-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গত কয়েক দিনে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। সতর্কতা না নিলে আমেরিকাতেও অচিরেই সংক্রমণের জোয়ার আসবে বলে প্রশাসনকে সতর্ক করেছেন মুখ্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অ্যান্টনি ফাউচি। স্বস্তিতে নেই ভারতও। দেশে দৈনিক সংক্রমণ দেড় হাজারের কোঠায় নেমে এলেও নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। অতীত দেখিয়েছে, বিদেশে সংক্রমণের ঢেউ আসার অব্যবহিত পরেই এই দেশেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং, প্রস্তুতি প্রয়োজন, অবিলম্বে।
কতটা প্রস্তুত এই দেশ এবং রাজ্য? ভারতে চতুর্থ ঢেউ শেষ পর্যন্ত আসবে কি না, এলেও তা ওমিক্রন, না কি অন্য কোনও ভ্যারিয়্যান্ট, সেই গবেষণা বিশেষজ্ঞরা করবেন। কিন্তু যে সতর্কবিধি মানার কথা চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলে এসেছেন এত দিন ধরে, এক আশ্চর্য বেপরোয়া মনোভাবে তা একেবারেই উধাও। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। সেখানে খাতায়-কলমে কোভিডবিধি এখনও বর্তমান, নৈশ-বিধিনিষেধও সম্পূর্ণ উঠে যায়নি। অথচ, সদ্যসমাপ্ত দোল এবং হোলি উপলক্ষে কোভিডবিধি উড়িয়ে অবাধে জনসমাগম হয়েছে, ন্যূনতম দূরত্ববিধি পালন করা হয়নি। ঠিক এইখানেই বিদেশ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। ওমিক্রনের রেশ না-মিলোতেই আমেরিকা এবং ইউরোপের অনেক দেশে প্রশাসনিক ভাবেই কোভিডবিধি কার্যত জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। মাস্ক পরার কড়াকড়িও শিথিল হয়। ‘স্বাভাবিকতা’য় ফেরার এই প্রবল তাড়নার ফল যে ভাল হয়নি, তা সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। এমতাবস্থায়, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে মনে রাখতে হবে, এই দেশে সবে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সিদের টিকাকরণ শুরু হয়েছে। প্রবীণদের তৃতীয় ডোজ় দেওয়ার কাজও এগোয়নি। এই পরিস্থিতিতে ফের একটি ঢেউয়ের ধাক্কা সহ্য করার মতো স্বাস্থ্য পরিকাঠামো প্রস্তুত আছে তো?
অর্থনীতির বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি ভারতের অর্থনীতিকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখেনি। ইতিমধ্যেই শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশের গণ্ডি। ফের লকডাউন গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষার বিষয়টিও উপেক্ষণীয় নয়। প্রায় দু’বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর সবে তার দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই দু’বছরের ক্ষতি অপূরণীয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পড়ুয়াদের বৃহৎ অংশ অনলাইন শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে চিরতরে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফের তালা পড়ুক, তা আদৌ কাম্য নয়। অর্থনীতি ছন্দে ফিরুক, শিক্ষাজগতের অন্ধকার দূর হোক, মানুষ সুস্থ নীরোগ থাকুক, পরিবর্তিত সময়ে এটাই ‘স্বাভাবিকতা’, উদ্দাম উচ্ছ্বাস প্রদর্শন নয়। এই বোধোদয় অত্যন্ত জরুরি, নাগরিকেরও, প্রশাসনেরও।