কেন্দ্রীয় সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিপাকে ফেলতে সিবিআই বা ইডির মতো তদন্ত সংস্থাগুলিকে কাজে লাগাচ্ছে— এই অভিযোগ গত আট বছরে কত বার শোনা গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। অভিযোগটি যে একেবারেই অস্বীকার করার নয়, সে-কথা বিজেপির নেতারাও বিলক্ষণ জানেন। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যখন বিরোধী দলগুলিকে কেন্দ্রের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান, সেই উদ্যোগের নৈতিক এবং ব্যবহারিক গুরুত্ব নিয়ে কোনও সংশয় থাকে না। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য শেষ অবধি কতটা দানা বাঁধতে পারে, সেটা বলা কঠিন, কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে উদ্যোগটি যে জরুরি, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তবে বিভিন্ন বিষয়ে শাসক দলের রাজনৈতিক স্বার্থে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের কাজে লাগানোর কতটা সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নও ওঠে বইকি। সেই সুযোগ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের দুর্নীতির কারণে তৈরি হতে পারে, আবার রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক অনাচারও খাল কেটে কুমির ডেকে আনতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বগটুই গ্রামের ভয়াবহ গণহত্যার ইতিবৃত্ত। লক্ষণীয়, এই ঘটনার তদন্ত সিট-এর হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে কলকাতা হাই কোর্ট যখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, তখন পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলেননি, বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শাসকদের চক্রান্তের দোষ আরোপ করেননি। বরং কেন্দ্রের তদন্তকারীদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এমন ‘অপ্রচলিত’ প্রতিক্রিয়ার কারণ কী, তা নিয়ে নাগরিকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে— এটা কি বেগতিক দেখে আদালতের নির্দেশটির সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল? খেলার প্রতিভা? এ-প্রশ্নের উত্তর জানা বোধ হয় বগটুইয়ের সত্য উদ্ঘাটনের থেকেও কঠিন। রাজনীতির কারবারিরা গভীর জলের মাছ, ইদানীং সে-জল আরও অনেক গভীর। কিন্তু একটা কথা অন্তত সাফ সাফ বলে দেওয়া যায়। বীরভূমের গ্রামটিতে যে ঘটনার বিবরণ মিলেছে এবং তার পরে পুলিশ প্রশাসনের যে আচরণের খবর পাওয়া গিয়েছে, তাতে তদন্তের ভার তাদের হাত থেকে সরিয়ে না নিলে কেবল বিস্ময় নয়, বিপুল উদ্বেগ জাগত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অধিকার নিশ্চয়ই রাজ্যের, কিন্তু সেই অধিকার পালন করতে গেলে কিছু ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে হয়। অপরাধ দমনে তৎপর হওয়ার শর্ত, অপরাধের তদন্তে এবং অপরাধীর শাস্তিবিধানে নিরপেক্ষ থাকার শর্ত। বগটুই কাণ্ডের শুরু থেকে সেই শর্তগুলি বারংবার ভয়ানক ভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে এবং আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি থেকে সেই অভিযোগ সত্য বলে আশঙ্কা করার বিস্তর কারণ তৈরি হয়েছে। অভিযোগের সংখ্যা এবং তার মাত্রা, দুইই ভীতিপ্রদ। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের যুক্তি দিয়ে সিবিআইয়ের তদন্তে আপত্তি তোলার কোনও উপায় যে থাকে না, সেটা হয়তো রাজ্যের শাসকরাও টের পেয়েছেন। বস্তুত, আদালতের নির্দেশের পিছনে সম্ভবত সেই ভারসাম্যেরও একটি ভূমিকা আছে— রাজ্য প্রশাসন নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বা অনিচ্ছুক হলে কেন্দ্রীয় তদন্ত অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থার রাজনৈতিক অপব্যবহার রোধ করা যতটা জরুরি, রাজ্য প্রশাসনের যথার্থ প্রশাসন হয়ে ওঠার দায়িত্বও তার থেকে কোনও অংশে কম জরুরি নয়, এই প্রাথমিক সত্যটি যদি রাজ্য সরকারের চালকরা উপলব্ধি করতে পারেন, তা হলে কেন্দ্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং জোরদার হবে।