ছবি: রয়টার্স।
সীমান্ত সমস্যা যেন পিছু ছাড়ছে না ভারতের। আবারও অস্থিরতার আবহ দেশের পূর্ব সীমান্তে। পড়শি রাষ্ট্র মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দিল্লির অলিন্দে। ২০২১ সালে আউং সান সু চি-র সরকারের পতনের পর থেকেই তপ্ত ছিল সে দেশের রাজনৈতিক আবহ। কিন্তু গত মাসের শেষে দিকে মায়ানমারের তিনটি বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’-এর ‘অপারেশন ১০২৭’ নামক যৌথ অভিযানে টলমল দেশের সামরিক জুন্টা সরকারের আসন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জুন্টা সরকারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষ চলছে ওই গোষ্ঠীর। বস্তুত ভারত ও চিন সীমান্তবর্তী বহু অঞ্চলই এখন বিদ্রোহীদের দখলে। নানা জায়গায় সামরিক আধিকারিকরা বিদ্রোহীদের হাতে আত্মসমর্পণ করেছেন, অনেকে পালিয়েছেন ছাউনি ছেড়েই। বিদ্রোহীদের এ-হেন আক্রমণের জবাবে জুন্টা সরকারের বিমানহানায় প্রাণ গিয়েছে সাধারণ মানুষেরও। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, সে দেশের প্রেসিডেন্ট মিয়ন্ট সুয়ে গৃহযুদ্ধের জেরে দেশ খণ্ডিত হওয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ায় সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আউং সান সু চি-র ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি’ (এনএলডি)-র নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করে দেশের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। সেই সময়ে এনএলডি-র নেত্রী-সহ বহু গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতাকে জেলবন্দি করা হয়। এমনকি দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে নানা প্রান্তে হওয়া আন্দোলনও কঠোর হাতে দমন করে তারা। সমীক্ষা বলছে, জুন্টা সরকারের আমলে সে দেশে চার হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারী এবং নাগরিক সেনার হাতে নিহত হন, কারারুদ্ধ হন কুড়ি হাজারেরও বেশি। অথচ, মায়ানমারে স্থিতবস্থা কায়েমে এ-যাবৎ কোনও পদক্ষেপই করেনি বর্তমান জুন্টা সরকার। গত কয়েক দশক ধরেই মায়ানমার সংখ্যালঘুদের জাতিগত দাঙ্গার সাক্ষী থেকেছে। কিন্তু পূর্বে সে দেশের রাজনৈতিক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকামী আন্দোলন পরিচালিত হত শান্তিপূর্ণ ভাবে, যার নেতৃত্বে ছিলেন খোদ আউং সান সু চি। কিন্তু তাঁর পতনের পরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি এ ভাবে নিজেদের জাতিগত ভেদাভেদ ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সরিয়ে রেখে একজোট হয়ে যে রুখে দাঁড়াবে, তার পূর্বানুমান করতে পারেনি জুন্টা সরকার।
মায়ানমারের অস্থিরতায় ভারতের উদ্বেগের কারণ বিবিধ। এক, মায়ানমারের সঙ্গে প্রায় ১৬৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে ভারতের। মিজ়োরাম সীমান্তের অদূরে একাধিক গ্রাম বিদ্রোহীদের দখল যাওয়ায় মায়ানমারের প্রায় পাঁচ হাজার গ্রামবাসী আশ্রয় নিয়েছেন ওই রাজ্যে। ভারতের চিন্তা, পড়শি রাষ্ট্রে সংঘাত তীব্র হলে উদ্বাস্তু সমস্যা অবধারিত ভাবে বৃদ্ধি পাবে উত্তর-পূর্বের রাজ্যটিতে। শুধু তা-ই নয়, মণিপুরের মতো রাজ্য, যা এত কাল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সাক্ষী ছিল, পড়শি রাষ্ট্রের অস্থিরতায় প্রভাবিত হতে পারে। তা ছাড়া মায়ানমারে চিনের প্রভাব প্রশমিত করতে ভারত ইতিমধ্যেই পরিকাঠামোগত প্রকল্প গড়ে তুলেছে, প্রস্তাবিত ভারত-মায়ানমার-তাইল্যান্ড ত্রিপাক্ষিক হাইওয়ে প্রকল্প যার অন্যতম। কিন্তু মায়ানমারের চিন প্রদেশের রিখাওদর বিদ্রোহীদের করায়ত্ত হওয়ায় তা এখন অনিশ্চয়তার মুখে। এ-যাবৎ জুন্টা সরকারের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে ভারত। কিন্তু এখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অঙ্কটি নতুন করে কষতে হবে দিল্লিকে।