—প্রতীকী ছবি।
দরজায় কড়া নাড়ছে অলিম্পিক্স, বিশ্বের চোখ এখন প্যারিসের দিকে। হাতে মোটে এক মাস, শহরটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার চূড়ান্ত সরকারি ব্যস্ততার মধ্যেই খবর এল, অলিম্পিক্সের বলি হতে চলেছেন প্যারিসের গৃহহীন পথবাসী ভিক্ষাজীবীরা। ফরাসি দাতব্য ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানগুলির এক রিপোর্ট তুলে ধরেছে বাস্তবচিত্র: কড়া পুলিশি অভিযানে উৎখাত হচ্ছেন এই মানুষেরা। এখনও পর্যন্ত এ বছরে এমন ‘অপারেশন’ হয়েছে ২৬টি— যেখানে গোটা ২০২২ সাল জুড়ে হয়েছিল মোট ৩০টি অভিযান। প্রথম বিশ্বের উন্নত মহানগরী প্যারিসে ঘরহারাদের জন্যও মাথা গোঁজার সরকারি ব্যবস্থা আছে, কিন্তু অলিম্পিক্স যত এগিয়ে আসছে ততই তাঁদের উপর চাপ বাড়ছে— রাজধানী থেকে দূরে, অন্যত্র চলে যাওয়ার। এমনকি শহরের যে অঞ্চলগুলিতে যৌনকর্মীদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ, সেখানেও বাড়ছে পুলিশি কড়াকড়ি: কাগজপত্র দেখতে চাওয়া, আটকে রাখা, হেনস্থা, বহিষ্কার। একই দশা শরণার্থীদেরও।
বিশ্বমানের অনুষ্ঠান, উৎসব, প্রতিযোগিতা বা সভার দায়িত্ব পেলেই প্রবল অর্থব্যয়ে শহরকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার সঙ্কল্প নেয় প্রশাসন, যার অনিবার্য পদক্ষেপ হয়ে ওঠে অসুন্দর ও কদর্যের অপসারণ। বলে বুঝিয়ে দিতে হয় না, দরিদ্র গৃহহীন ভিক্ষাজীবী যৌনকর্মী বা শরণার্থীরাই তখন রাষ্ট্রের কাছে চক্ষুশূল, মূর্তিমান অস্বস্তি; সেই কারণেই পুলিশ ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এঁদের অস্তিত্বকে ঢাকাচাপা দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়। উদ্দেশ্য, বাকি পৃথিবী যেন জানতে না পারে এঁদের উপস্থিতি, তা হলেই আয়োজক শহর তথা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির দফারফা। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বড় বালাই, কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সৌন্দর্য ও বৈভবের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে আছে বলেই শুধু দরিদ্র গৃহহীন বা শরণার্থীদের প্রতি রাষ্ট্রের বিরাগ নয়। আসলে এঁদের উপস্থিতি মানে এই মানুষগুলির প্রতি রাষ্ট্রের চরম অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ। রাষ্ট্র তথা সরকার এই ব্যর্থতা মানতে পারে না বলেই এঁদের উপর খড়্গহস্ত হয়, বৃহৎ কোনও উদ্যাপনের অজুহাতে এঁদের মুছে ফেলতে তৎপর হয়ে ওঠে। সঙ্গী হয় নানা সাফাই: প্যারিসের ক্ষেত্রে যেমন মহানগরে আবাসন-সমস্যার প্রকটতাকে তুলে ধরেছে ফরাসি প্রশাসন— অলিম্পিক্স এগিয়ে আসার মুখেই কেন আচমকা এ সমস্যা মাথাচাড়া দিল, কেনই বা তার জন্য গৃহহীন ও শরণার্থীদের শহরছাড়া করতে হবে, সে প্রশ্নের উত্তর নেই।
চক্ষুশূল অপসারণ-অভিযানে প্যারিস আর দিল্লিতে প্রভেদ নেই। গত বছর ভারতের রাজধানীতে জি২০ সম্মেলনের সমাপ্তিপর্বের আবহে খবরে উঠে এসেছিল দিল্লির নানা এলাকা, রাস্তা ও রাজপথ থেকে দরিদ্র ভিক্ষাজীবী মানুষদের একই ভাবে রাতারাতি সরিয়ে ফেলার ঘটনা। নরেন্দ্র মোদী সরকার রাজধানীর সৌন্দর্যায়নের সাফাই গেয়ে এই অপসারণ করেছিল কড়া হাতে, মানবাধিকার সংগঠনগুলির সরব প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে। একই গোছের ঘটনা দেখা গিয়েছে চিন-এও। উন্নত আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, অমানবিকতার আচরণে দুইয়েরই সরকার সমান। তাদের অঙ্গুলিহেলনে বিশ্বকাপের ঝাঁ চকচকে স্টেডিয়াম, অলিম্পিক্সের অত্যাধুনিক পরিষেবার ‘গেম ভিলেজ’ গজিয়ে উঠবে অসম্ভব দ্রুততায়, আর তারই যুক্তিতে দুর্গত হবেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। প্রদীপের ঠিক নীচেই জমবে গাঢ় অন্ধকার।