একবিংশ শতকের শব্দভান্ডারে একটি শব্দ ক্রমেই গুরুতর হইয়া উঠিয়াছে— ‘ফোমো’। পূর্ণাবয়বে, ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’। মনস্তাত্ত্বিকরা বলিতেছেন, নিরন্তর সোশ্যাল মিডিয়া-যাপনের এই যুগে ‘ফোমো’ একটি জটিল মানসিক সমস্যার রূপ লইতেছে। ভাঙিয়া বলিলে, সমস্যাটি নিম্নরূপ: ফিয়ার অব মিসিং আউট হইল পিছাইয়া পড়িবার ভয়; অন্যরা সব সুখ পাইয়া গেল, প্রচারের সমস্ত আলো অন্যদের উপরে পড়িল, সমস্ত উত্তেজনা অন্যরা পোহাইয়া লইল, সকল আলোচনার কেন্দ্রে থাকিল— সর্বক্ষণের এই আশঙ্কাই ফোমো। মনস্তাত্ত্বিকরা বলিবেন, এই ব্যাধির চিকিৎসা সহজ— যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া হইতে নিজেকে সরাইয়া রাখা; যাহা নাই, তাহার জন্য বিচলিত না হইয়া যাহা আছে, তাহাতে মনোনিবেশ করা। কিন্তু হিতোপদেশে আর কে কবে কর্ণপাত করিয়াছে? ফলে, ফোমো-র অন্তর্দাহ চলিতেছে। সেই দহনের এক বিচিত্র প্রকাশ লক্ষ করা যায়— ঘটমান বর্তমানের কার্যত প্রতিটি মুহূর্তের সহিত নিজের অবিচ্ছেদ্য যোগ প্রমাণের চেষ্টা। যেমন, কোনও বিশিষ্ট মানুষ প্রয়াত হইলে তাঁহার সহিত আপন সম্পর্কের কথা ফলাও করিয়া লেখা। শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়া ভরিয়া গেল ব্যক্তিগত শোকযাপনের প্লাবনে। অনেকেই কবির সহিত নিজের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক (অর্থাৎ, তিনি এক দিন দূর হইতে কবিকে নমস্কার করিয়াছিলেন; এবং কবির পছন্দের মিষ্টান্ন ভান্ডার হইতেই তিনিও কেনাকাটা করিয়া থাকেন) বিষয়ে বিস্তারিত লিখিয়া জানাইয়াছেন, কবির স্বভাবধর্মই ছিল নিজেকে কখনও জাহির না করা, প্রচ্ছন্ন থাকা!
ফোমো আসিয়া কী ভাবে শোককে ক্রমে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক উৎসবে পরিণত করিতে পারে, তাহার একটি মোক্ষম উদাহরণ যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সাম্প্রতিক ইয়াস-ই যেমন। যাঁহারা এই ঝড়ের কেন্দ্রে ছিলেন, আশঙ্কা হয়, তাঁহাদের অধিকাংশের হাতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আপলোড করিবার সময় ছিল না। কিন্তু, এই ঝড় হইতে নিরাপদ দূরত্বে বসিয়া অনেকেই নিজেদের টাইমলাইন ভরাইয়া ফেলিলেন তাহার পূর্বাভাসে, উপগ্রহ-চিত্রে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ছবি-ভিডিয়োয়, ধারাবিবরণীতে। একে অপরের সমালোচনায়, আবার কখনও কোনও তৃতীয় পক্ষের সমালোচনাতেও বটে। শেষ অবধি শহর কলিকাতায় ঝড় না আসায় অনেকের ছদ্ম স্বস্তি ভেদ করিয়া প্রকাশ হইয়া পড়িল দীর্ঘশ্বাস— এই ঝড়ের অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ অংশীদার থাকিবার সুযোগ ফস্কাইয়া যাইবার বেদনায়। প্রত্যেকেই কি নামিয়া পড়িলেন না অপরের তুলনায় খানিক হইলেও আগাইয়া থাকিবার দৌড়ে? ফোমো তাহাই করাইয়া থাকে— কোনও দৌড়েই পিছাইয়া পড়া চলিবে না, এই তাগিদ মাথায় চারাইয়া দেওয়াই ফোমো-র চরিত্রলক্ষণ।
ফলে, সোশ্যাল মিডিয়ার ভুবন জুড়িয়া কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। যে কোনও ছবির— আক্ষরিক অর্থে ছবি, অর্থাৎ স্থিরচিত্র অথবা চলচ্চিত্র— মধ্যে কিছু কথা নিহিত থাকে, অর্থ নিহিত থাকে। সাঁজোয়া গাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন এক জন— নিতান্ত এক জন, একক ব্যক্তিবিশেষ— এই ছবিটি কোনও কথা না বলিয়া যেমন বলিয়া দেয় বিদ্রোহ ঘোষণার কথা; আয়লান কুর্দির নিথর দেহটি যেমন বলে যে, পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করিবার স্বপ্নটি বহুলাংশে অধরাই থাকিয়া গিয়াছে; তেমনই নাপাম বোমার সম্মুখে ধাবমান কিশোরী, অথবা মুমূর্ষু বালকের পার্শ্বে অপেক্ষমাণ শকুনের ছবির অন্তর্নিহিত কথাগুলির অভিঘাত প্রশ্নাতীত। অপরিচিত, আপাত-অকিঞ্চিৎকর বহু ছবিও অজস্র কথা বলিতে পারে। কিন্তু যত ক্ষণ সেই ছবিকে কথা বলিবার পরিসর দেওয়া হইতেছে, তত ক্ষণই। যে মুহূর্তে ছবিটির জ্ঞাপনের তুলনায় জ্ঞাপকই প্রধান হইয়া উঠেন— যে মুহূর্তে কেহ জানাইয়া দেন যে, ছবির বার্তাটির তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যটি যে, ছবিটি তিনি শেয়ার করিতেছেন— সেই স্ব-প্রজ্ঞাপনের মুহূর্তে ছবিটি তাহার অর্থ হইতে বিচ্যুত হয়। ছবিগুলি ক্রমে কোলাহলে পরিণত হইতে থাকে— অনেকের সম্মিলিত বাচন-প্রয়াস, যাহা হইতে কোনও অর্থ উদ্ধার করা অসম্ভব। এই কোলাহলটিই ফোমো-র বৃহত্তম অভিশাপ। যখন সকলেই কথা বলেন কথা না শুনিয়া, কথা শোনেন কথা না শুনিয়া— তখন কথার আর কোনও অর্থ থাকে না। থাকে না তাহার কোনও দাম। তখন যে কোনও শোক, যে কোনও ক্রোধ, যে কোনও হতাশা শেষ অবধি এক প্রতিযোগিতামূলক উৎসব হইয়াই থাকিয়া যায়। অর্থহীনতার উৎসব। অকিঞ্চিৎকরতার উৎসব।