তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে পরাগসঞ্চার থেকে ফসল পাকার সময়কাল, প্রভাবিত হয় সবই। প্রতীকী ছবি।
জলবায়ু বিরূপ হলে কৃষিতে যে তার প্রভাব পড়বেই, এ কথা বুঝতে বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে। সেই প্রভাব কতখানি ভয়ঙ্কর, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিল রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিয়োরোলজিক্যাল অর্গানাইজ়েশন। সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্টে আলোচিত হয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কৃষির দুরবস্থার কথা। সেই আলোচ্য তালিকায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে দুই প্রতিবেশী দেশ— ভারত এবং পাকিস্তান। ২০২২ সালের মার্চ এবং এপ্রিলের তাপপ্রবাহে ভারতের ন’টি রাজ্যে কৃষি উৎপাদন প্রবল ভাবে ব্যাহত হয়েছিল। খাদ্যশস্য, আনাজ থেকে আরম্ভ করে দুধ, ডিম— উৎপাদন কমেছিল সবেরই। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে পরাগসঞ্চার থেকে ফসল পাকার সময়কাল, প্রভাবিত হয় সবই। তার ফলে উৎপাদন কমে। সেচের জলের অভাব ঘটলেও ফসলের ক্ষতি। অন্য দিকে, গবাদি পশুর শারীরিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুধের উৎপাদন কমে। গত বছরের তুলনায় এ বারের তাপপ্রবাহ তীব্রতর। পশ্চিমবঙ্গের মতো যে রাজ্যগুলি স্বভাবত তাপপ্রবাহের মানচিত্রের বাইরে থাকে, এ বার সেখানেও দহন তীব্র। ফলে, কৃষির সঙ্কট যে গত বারের চেয়েও ভয়াবহ হতে চলেছে, সেই আশঙ্কা প্রবল। অবশ্য শুধু ভারতেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রবল কুপ্রভাব পড়ছে কৃষির উপরে। ফলে, খাদ্য-অনিশ্চয়তার মাত্রাও বাড়ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব হল, ২০২১ সালে গোটা দুনিয়ায় প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ খাদ্য-অনিশ্চয়তার শিকার হয়েছিলেন; তাঁদের মধ্যে ৯২ কোটিরও বেশি মানুষ পড়েছিলেন তীব্র খাদ্য-অনিশ্চয়তার মুখে। এবং, গোটা দুনিয়ায় যত মানুষ খাদ্য-অনিশ্চয়তার শিকার, তাঁদের প্রতি দু’জনে এক জন এশিয়ার বাসিন্দা।
কৃষির সঙ্কট শুধু খাদ্য-অনিশ্চয়তারই জন্ম দেয় না, তা সামগ্রিক অর্থব্যবস্থাকে নিয়ে যায় গভীরতর বিপদের দিকে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যার সিংহভাগ গ্রামাঞ্চলে থাকেন, এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষি অর্থনীতির উপরে নির্ভরশীল, সেখানে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পড়ে গ্রামীণ ক্রয়ক্ষমতার উপরে। ফলে, সামগ্রিক ভাবে গ্রামীণ চাহিদা হ্রাস পায়। চাহিদা হ্রাস পাওয়ার অর্থ উৎপাদন হ্রাস, যা থেকে কর্মসংস্থানের চাহিদা কমে, আয় কমে, বেকারত্বের হার বাড়ে। ফলে তৈরি হয় সামগ্রিক নিম্ন চাহিদার পরিস্থিতি। নিম্ন চাহিদার চক্র তৈরি হলে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথটি রয়েছে কেন্সীয় অর্থনীতির তত্ত্বে। কিন্তু, ২০১৬ সাল থেকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বিপদ থেকে বিপদান্তরে বয়ে চলেছে— তার কিছু অদৃষ্টপূর্ব, কিছু স্বখাতসলিল— সব মিলিয়ে কেন্সীয় অর্থনীতির পথে হাঁটার সামর্থ্য এবং ইচ্ছা, উভয়েরই ঘাটতি রয়েছে। ফলে, পরিবেশজনিত কারণে কৃষি সঙ্কটে পড়লে তা অদূর ভবিষ্যতেই সমগ্র অর্থব্যবস্থার সঙ্কটে পরিণত হবে, এই আশঙ্কা প্রবল।
এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথে হাঁটতে হলে প্রথম কর্তব্য, কৃষির এই সমস্যা যে দু’এক বছরের নয়, এই কথাটিকে নীতিনির্ধারণের স্তরে স্বীকার করা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ আর ভবিষ্যতে নেই, তা শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০২২ ও ২০২৩ কোনও ব্যতিক্রমী বছর নয়— পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতের চেহারা এমনই হবে। এই কথাটিকে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার একেবারে কেন্দ্রে রাখতে হবে। এই ‘নিউ নর্মাল’-এ কৃষি-নীতি কী হবে, কোন গবেষণায় জোর দিতে হবে, কী ভাবে বীজ, ফসলকে আরও তাপসহ করে তোলা যায়, কী ভাবে তুলনায় কম জল ব্যবহার করে সেচের কাজ করা যায়— এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধান করতে হবে। চাষের চক্রে কোনও পরিবর্তন করা যায় কি না, ভাবতে হবে সে কথাও। এবং, কৃষককে প্রস্তুত করে তুলতে হবে সেই নতুন পরিস্থিতির জন্য। কিন্তু, সবার আগে বিপদটি স্বীকার করা প্রয়োজন।