ফাইল চিত্র।
সরকারকে ফ্যাসাদে ফেলিতে পরিযায়ী শ্রমিকের জুড়ি নাই। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়াছে, সকল পরিযায়ী শ্রমিককে বিনামূল্যে রেশন দিতে হইবে, তাঁহাদের পরিচয়পত্র দাবি করা চলিবে না। গণরসুইও শুরু করিতে হইবে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানার রাজ্য সরকারের প্রতি এই নির্দেশ অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা মাত্র। পরিযায়ী শ্রমিকদের সকল প্রকার সুরক্ষার জন্য রাজ্য কী করিতেছে, তাহা হলফনামা দিয়া জানাইতে বলিয়াছে আদালত। একে অতিমারি সামলাইবার কাজের বোঝা, তাহার উপর শ্রমিক কল্যাণের শাকের আঁটি— সরকারে থাকিলে কতই না চাপ সহিতে হয়! দেশবাসীও বিস্মিত। গত বৎসর ১৬ মে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করিয়াছিলেন, এক বৎসরের মধ্যে ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’ নীতি কার্যকর হইবে। সেই প্রতিশ্রুতি কি তবে পূরণ হয় নাই? নচেৎ কেন শ্রমিকের পরিচয়পত্র না দেখিয়া রেশন দিবার নির্দেশের প্রয়োজন হইল? তবে বুঝি ভারতের রেশন দোকানে ডিজিটাল যুগ আসে নাই। শ্রমিকরাও বড়ই অবুঝ। তাঁহারা খাদ্যসুরক্ষা, এবং ঘরে ফিরিবার বাস-ট্রেন পাইবার জন্য সরকারের মুখ চাহিয়াই বসিয়া আছেন। হয়তো গত বৎসরের অভিজ্ঞতা তাঁহারা ভুলিয়া যান নাই। ঘরে ফিরিবার পথে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ঘটনায়, পথশ্রমে, অনাহারে মৃত্যুর কথা মনে করিলে তাঁহারা হয়তো এখনও কাঁপিয়া উঠেন। প্রশাসন অত দুর্বলচিত্ত নহে, দরিদ্রকে ‘আত্মনির্ভর’ হইবার পরামর্শ দিয়া নিশ্চিন্তে ছিল। গোল বাধাইল সুপ্রিম কোর্ট। তাহার নির্দেশ, পরিযায়ীদের জন্য নিখরচায় খাদ্য ও পরিবহণের ব্যবস্থা করিতে হইবে সরকারকে।
দেশবাসী দেখিতেছে, আদালত তাড়না না করিলে পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য প্রশাসন কিছুই করিয়া উঠিতে পারে না। অবশ্য নির্দেশ পাইলেই তাহা পালন করে, এমনও নহে। ২০২০ সালে মার্চে লকডাউন শুরু হইবার পরে পরিযায়ী শ্রমিকদের যে প্রবল সমস্যায় পড়িতে হয়, তাহার প্রতিকার চাহিয়া জনস্বার্থ মামলা হইয়াছিল শীর্ষ আদালতে। অতঃপর শীর্ষ আদালত একের পর এক নির্দেশ দিয়াছে, এবং কিছু দিন পরেই সরকারকে তলব করিয়া হলফনামা দাবি করিয়াছে, কেন সেই নির্দেশ কাজে পরিণত হয় নাই। যেমন, গত বৎসর মে মাসে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিনামূল্যে বাস ও ট্রেনে ঘরে ফিরিবার ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়াছিল আদালত। জুন মাসেই বিচারপতিরা জানিতে চাহিয়াছেন, কেন সরকার পরিবহণে ভাড়া দাবি করিতেছে। এই বৎসরও আদালত জানিতে চাহিয়াছে, এই বিষয়ে গত বৎসরের নির্দেশ কেন অনুসৃত হয় নাই।
ক্ষুব্ধ বিচারপতিদের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হইতে এই করুণ সত্যই প্রকাশ পায় যে, পরিযায়ী শ্রমিককে অবৈধ, অপরাধী, এবং অকারণ বিপত্তি বলিয়া দেখিবার প্রশাসনিক অভ্যাসটি সহজে যাইবার নহে। হয়তো ইহা কেবল ‘সরকারি মনোভাব’-এর সমস্যা নহে। এক কোটি মানুষের খাদ্যসুরক্ষা, বৈধ বাসস্থান, সুষ্ঠু পরিবহণ এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক পরিষেবার পরিকাঠামো গড়িয়া তুলিতে দীর্ঘ সময় ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। ইহার কোনওটিই হঠাৎ হইবার কাজ নহে। তাই নাচার শিশুর বেঞ্চে দাঁড়াইবার মতো, বার বার কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া ধমক খাইতে হইতেছে সরকারকে। যে ধরনের নেতৃত্ব গয়ংগচ্ছ প্রশাসনিকতা অতিক্রম করিয়া পরিযায়ী শ্রমিকের নিকট পৌঁছাইতে পারে, তাহা ভারতে নাই।