ফাইল চিত্র।
রাজনীতিতে প্রধান শক্তিগুলি যখন পথভ্রষ্ট হয়, নাগরিক স্বার্থ দেখিবার বদলে ব্যক্তিস্বার্থ ও সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করিবার ফিকির খোঁজে, তখনই বিকল্প শক্তির অনুসন্ধান প্রয়োজন হইয়া পড়ে। রবিবারের ব্রিগেড সমাবেশ কোনও বিকল্প শক্তির সন্ধান দিল, এমন দাবি করা অসম্ভব। কিন্তু, রবিবারের ব্রিগেডের জনজোয়ারের মধ্যে একটি বার্তা চোখে পড়িবার মতো। সে দিনের সমাবেশে বিপুল সংখ্যক তরুণদের যোগদান হয়তো বলিয়া যায় যে, ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন যে পথে চলিতেছে, তাহার উপর সম্ভবত এই প্রজন্মের যথেষ্ট আস্থা নাই। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে হয়তো ইঁহাদের সংখ্যা অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু ইঁহারা যে বর্তমান রাজনীতির অন্ধকূপে স্বচ্ছন্দ বোধ করিতেছেন না, তাহা স্পষ্ট। হতাশা আর অবসাদের দিনে নিঃসন্দেহে এইটুকুই কি ভরসা দিবার মতো ঘটনা নয়?
সম্প্রতি আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরিয়া তরুণ সমাজের ভাবনা লইয়া আনন্দবাজার পত্রিকার এক সংবাদ সমীক্ষাতেও এই অস্বাচ্ছন্দ্যের ভাবনাটি ধরা পড়িয়াছে। সমীক্ষায় যে অল্পসংখ্যক তরুণ-তরুণীর ব্যক্তিগত মত ধরা পড়িয়াছে, তাহার মধ্যে সামগ্রিকতার সন্ধান করা চলে না। ইঁহারাই যে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন, এমন সরল সিদ্ধান্তেও আসা যায় না। কিন্তু এই সমীক্ষাকে যদি নূতন প্রজন্মের ভাবনার এক ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবিমাত্রও হয়, তাহা হইলেও কিন্তু একটি স্বস্তিদায়ক ইশারা পাওয়া সম্ভব। সেই ইশারা বলে, অন্তত কিছু অল্পবয়সি নাগরিক ভাবিতেছেন, রাজনীতিতে ধর্ম নহে— বরং কর্মসংস্থান, খাদ্যের নিরাপত্তা এবং নারীর সুরক্ষার ন্যায় বিষয় প্রাধান্য পাওয়া উচিত। ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইতে পারে, কিন্তু তাহা ব্যক্তিগত পরিসরে। সাম্প্রতিক কালে রাজনীতি যে অন্যায় ভাবে ধর্মকে ব্যবহার করিতেছে, তাহা এই প্রজন্মের পছন্দ নহে। অতীতেও ভারতে ধর্ম ছিল, রাজনীতি ছিল, নির্বাচন ছিল। কিন্তু ধর্মের নামে রাজনীতি ও সমাজের এই ভাগাভাগি অন্য সমস্ত বিষয়কে পিছনে ফেলিতেছে, এমনটি স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায় নাই। অথচ, এ বারের নির্বাচনে এই অবাঞ্ছিত ঘটনাই ঘটিতেছে, রাজনীতি ভাবনার প্রথম সারিতে উঠিয়া আসিতেছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। সমীক্ষা বলিল, বাংলার বহু তরুণতরুণীর ইহা না-পসন্দ্।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রাজনীতির প্রবেশ তাঁহারা পছন্দ করিতেছেন না। শ্রদ্ধেয় মনীষীদের নাম লইয়া অর্বাচীন রাজনৈতিক চর্চাও এই বঙ্গে নূতন। মনীষীদের আদর্শ, ভাবনা, কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহী না হইয়া, শুধুমাত্র নির্বাচনের স্বার্থে কিছু নাম এবং বাণীর বিকৃতরূপ লইয়া নির্লজ্জ আত্মপ্রচারে যে অন্তঃসারশূন্যতা এবং আত্মসিদ্ধির তাগিদ— তাহা ধরা পড়িতেছে বহু তরুণের চোখে। স্বস্তিদায়ক। অন্তত সমাজের একাংশ যে এই রাজনৈতিক ভণ্ডামিতে গা ভাসায় নাই, তাহা আশা জাগায়। এই দেশে এবং এই রাজ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রমাগতই এমন এক অবস্থায় পৌঁছাইতেছে, যেখানে বৃহৎ আদর্শ বা স্বচ্ছ ভাবনার কোনও স্থান নাই। চর্চা নাই প্রাত্যহিক জীবনে নাগরিক সমস্যাগুলি লইয়াও। রাজনীতিতে পড়িয়া আছে শুধুমাত্র অন্তহীন দুর্নীতি, প্রলোভন এবং সুযোগসন্ধানী মানসিকতা। বর্তমানের এই অন্ধকারে একমাত্র ভরসা, তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ভাবনা।