জো বাইডেন। —ফাইল চিত্র।
একটি যুদ্ধ গোটা পৃথিবী জুড়ে কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কত ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে, ইতিমধ্যেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার সূত্রে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে ইন্দো-প্যাসিফিক বা ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলেও তেমন কোনও পরিস্থিতির উদ্রেক হোক, সেটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। অথচ পরিস্থিতি ক্রমশই উদ্বেগজনক হচ্ছে। সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চৌত্রিশ কোটি পঞ্চাশ লক্ষ ডলার মূল্যের সামরিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করল জো বাইডেন সরকার। অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের পাশাপাশি পেন্টাগন তাইওয়ান সেনাকে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সহায়তাও দেবে বলে জানা গিয়েছে। আমেরিকান বিদেশসচিব এবং অর্থসচিবের চিন সফরের পরই এই ঘোষণা। স্বভাবতই উষ্মা বাড়ছে চিন সরকারের। প্রসঙ্গত, গত বছর অগস্টে আমেরিকার তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরে যান চিনের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে। তার পর থেকেই তাইওয়ান প্রণালী এবং পাশের চিন সাগরে সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে চিন। ধারাবাহিক ভাবে লঙ্ঘন করে দ্বীপরাষ্ট্রটির আকাশসীমাও। এতে প্রভাবিত হয়েছে ওই অঞ্চলের বাণিজ্যিক উড়ান এবং নৌ-চলাচল। আশঙ্কা বেড়েছে তাইওয়ান হামলারও। ভুললে চলবে না, চিনের জাতীয়তাবাদী দল কুয়োমিনটাং-এর সূত্রে এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্রটির সঙ্গে তাইওয়ানের একটি ঐতিহাসিক যোগ রয়েছে। সেই সূত্র ধরেই আজ ওই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে চায় তারা। মুশকিল হল, চিন যদি তাইওয়ানের উপর নিজের দখল জারি করতে সক্ষম হয়, তা হলে তা সম্পূর্ণ বদলে দেবে এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক চিত্রটিকে। বিপদ বাড়বে জাপান, ফিলিপিনসের মতো চিন-বিরোধী রাষ্ট্রগুলির। অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকারও— দক্ষিণ চিন সাগরে যাদের স্বার্থ জড়িত। আমেরিকার স্বার্থই সবচেয়ে বেশি, কেননা, এ তো কেবল সামরিক প্রশ্ন নয়, কূটনৈতিক ক্ষমতারও প্রশ্ন। আমেরিকার এত দিনের ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র’-এর ভাবমূর্তিতেও তা হলে বড় আঘাত হানবে চিন।
অন্য দিকে, পুনরায় ধাক্কা খাবে বিশ্ব অর্থনীতি। কারণ, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপের দৈনন্দিন ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র থেকে গাড়ি— সব কিছুই চালায় যে কম্পিউটার চিপস, তার সিংহভাগই তৈরি হয় তাইওয়ানে। তাইওয়ান যদি সরাসরি চিনের দখলে যায়, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্পের নিয়ন্ত্রণ তবে চলে যাবে বেজিং-এর হাতে। শুধু তা-ই নয়, তার শাসনে গণতন্ত্র যে কী ভাবে বিলুপ্তপ্রায় হতে পারে, হংকং আজ তার ভয়ঙ্কর উদাহরণ। তাইওয়ানও অচিরেই সেই একই পরিণতির শিকার হতে পারে।
ভারতের উদ্বেগও গুরুতর। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার মোট বাণিজ্যের অর্ধেকের বেশি হয় দক্ষিণ চিন সাগরের মধ্যে দিয়ে, যা ব্যাহত হবে সেই সময়ে। ধাক্কা খাবে তাইওয়ানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও, যা গত কয়েক বছরে ছিল ক্রমবর্ধমান। বাণিজ্য বাদে, ভূরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ‘কোয়াড’-এর সদস্য হিসাবেও চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে চাপ বাড়বে ভারতের উপরে। এবং এই অঞ্চলে ভারত যুদ্ধে যোগ দিলে চিন তার প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য হিমালয় অঞ্চলকে বেছে নিলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে ভারতকে। তাইওয়ান-চিন টানাপড়েনের উপর তাই তীক্ষ্ণ নজর রাখা ছাড়া গতি নেই দিল্লির।