—ফাইল চিত্র।
শিয়ালদহ স্টেশনের সংস্কার চলাকালীন যাত্রীদের যে চরম দুর্ভোগ হল, তার সামনে দাঁড়িয়ে একটাই প্রশ্ন করতে হয়— এই দুর্ভোগ কি এড়ানো যেত না? ভিড়ের চাপে ট্রেন থেকে পড়ে এক যাত্রীর মৃত্যু, প্রাণ বিপন্ন করে অগণিত মানুষের যাত্রা, কর্মদিবস নষ্ট, বিকল্প যাত্রার ব্যবস্থা করতে বাড়তি সময় ও অর্থব্যয়— এতগুলি মানুষের এমন তীব্র সঙ্কটের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ কি দায়ী নন? সেই দায়িত্ব কি অনুভূত হল আদৌ? প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজ কবে, কখন করা উচিত, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তো সম্পূর্ণ রেল কর্তৃপক্ষের অধীন। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নামতে কোনও বাধা ছিল না। নিয়মিত কর্মদিবসে কত ট্রেন চলে, কত যাত্রী যাতায়াত করেন, সে সব তথ্যই থাকার কথা তাঁদের কাছে। শিয়ালদহ মেন এবং বনগাঁ শাখায় ভিড়ের চাপ যে স্বাভাবিক পরিষেবার দিনেও অত্যধিক, তা-ও অজানা থাকার কথা নয়। কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু রেলের পূর্ব প্রস্তুতির কোনও চিহ্নই খুঁজে পাওয়া গেল না। এক থেকে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম বন্ধ থাকবে, এটুকু ঘোষণা করেই রেল দায় সেরেছে। শুক্রবার ছিল একটি নিয়মিত কর্মদিবস। সে দিন ৯০টি ট্রেন বাতিল হয়েছে, কিন্তু কোন কোন ট্রেন বাতিল, কোনগুলি চলবে, সেগুলির পরিবর্তিত সময় কী, কোনগুলির যাত্রাপথ বদলেছে, কিছুই ঘোষণা করা হয়নি। শনিবার এবং রবিবারও এই ছবির পরিবর্তন হয়নি, সোমবারও স্বাভাবিক ছিল না পরিষেবা। তার ফলে কী প্রাণান্তকর হয়রানি হয়েছে যাত্রীদের, তার সাক্ষ্য মিলেছে সংবাদমাধ্যমে। তীব্র গরমের মধ্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, ভিড়-ঠাসা কামরা, দরজার বাইরে ঝুলন্ত যাত্রী, এ সব দৃশ্য দেখা গিয়েছে। লোকাল ট্রেনের পাশাপাশি দূরপাল্লার ট্রেনগুলিও প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেছে। যাত্রীদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। অনেকে কর্মস্থলে পৌঁছতে পারেননি। শিয়ালদহ স্টেশনে ক্ষিপ্ত যাত্রীদের ভাঙচুর সমর্থনযোগ্য নয়, তবে অপ্রত্যাশিতও নয়। অসহায়ের ক্রোধ এমন বিধ্বংসী রূপই নেয়।
আক্ষেপ এই যে, পরিষেবায় এমন বিপুল ত্রুটির মুখে দাঁড়িয়ে রেল কর্তৃপক্ষ বিন্দুমাত্র দুঃখপ্রকাশ করেননি, ক্ষমাপ্রার্থনা তো দূরের কথা। বরং রেলের তরফে যে বিবৃতিগুলি প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো পড়লে মনে হয়, একে যেন ‘সামান্য ক্ষতি’ বলেই মনে করছেন তাঁরা। পূর্ব রেলের জনসংযোগ আধিকারিক জানিয়েছেন, অসুবিধার তুলনায় হইচই বেশি হয়েছে। কাজ সমাপ্ত হওয়ার পরে রেল কর্তৃপক্ষের তরফে যে বিবৃতি জারি করা হয়েছে, সেখানেও দুঃখপ্রকাশের লেশমাত্র নেই। বরং সংস্কারের ফলে আরও উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা পাবেন যাত্রীরা, এমন সুখবর শুনিয়েছেন। উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা যাত্রীদের পাওয়াই উচিত, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু রেলের যাত্রীরাও কি উপভোক্তার সম্মান পাওয়ার যোগ্য নন? বিমান পরিষেবায় যদি বিলম্ব, হয়রানি হয়, বিশেষত যদি পরিষেবার ত্রুটির সঙ্গে যাত্রীর দৈহিক অসুস্থতা বা মৃত্যুর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয় রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাকেও। রেলের ক্ষেত্রে কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার উপভোক্তাকে ‘জনতা’ বলে দেখার একটি প্রবণতা দেখা যায়। তাঁদের প্রাণ বা সময়ের দাম রয়েছে, তার প্রতিফলন রেলের কাজে দেখা যায় না।
এই মনোভাব পরিবর্তনের সময় এসেছে। রেলযাত্রীদের প্রাণ, তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্য ও সময়ের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে। প্রথমত, ৭-১০ জুন শিয়ালদহ মেন ও উত্তর শাখার যাত্রীদের চূড়ান্ত হয়রানি হয়েছে, তা রেল কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্ল্যাটফর্ম সম্প্রসারণের কাজ আরও সুপরিকল্পিত ভাবে করা গেল না কেন, কারা এর জন্য দায়ী, তদন্ত করে তা নির্ণয় করতে হবে। তৃতীয়ত, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ট্রেন বাতিল, ট্রেনের বিলম্ব লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিপন্ন করে। একে কখনওই লঘু ভাবে নেওয়া চলে না।