আংশিক অসাড় করে অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে, স্নায়ুর পথ রোধ করে ব্যথার বোধ রুখে দেওয়া, সব প্রকরণই এখন চিকিৎসকদের হাতের মুঠোয়। প্রতীকী ছবি।
ফেব্রুয়ারির গোড়ায় অমৃতসরে হয়ে গেল ব্যথা সম্মেলন। ব্যথার চিকিৎসকদের একটি জাতীয় সংগঠনের এই বাৎসরিক সভায় যন্ত্রণা উপশমের বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলের সঙ্গে আলোচনা হয় নৈতিকতা, রাজনীতি নিয়েও। রাজনীতি প্রায়ই যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু যন্ত্রণা নিয়েও যে চলে রাজনীতি, সে কথাটা একটু ধাক্কা দিয়ে যায়। ব্যথাকে নিছক জৈবিক সংবেদন বলে ভাবার দিকেই মনটা ঝোঁকে বেশি। সমস্ত প্রাণী-জগৎকে যদি কিছু একসূত্রে বেঁধে রাখে, তবে তা ব্যথার বোধ। “আঘাতের পর গাছের প্রকৃতিস্থ হইতে প্রায় পনেরো মিনিট লাগে,” লিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কেন্দ্রে অবশ্য কেবলই মানুষ। তার ব্যথা নিয়ন্ত্রণে এমনই সিদ্ধহস্ত হয়েছেন চিকিৎসকেরা যে, এখন অস্ত্রোপচারের টেবিলে রোগী দিব্যি শ্যামাসঙ্গীত গায়, কিংবা ঝালিয়ে নেয় ছেলেবেলায় শেখা আবৃত্তি। আংশিক অসাড় করে অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে, স্নায়ুর পথ রোধ করে ব্যথার বোধ রুখে দেওয়া, সব প্রকরণই এখন চিকিৎসকদের হাতের মুঠোয়। তা সত্ত্বেও ব্যথা তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কারণ ব্যথা তো কোনও রোগ নয়, তা হল মস্তিষ্কপ্রসূত বোধ। দেহকোষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদানগুলিকে অণুবীক্ষণের তলায় দেখে, তাদের কেটে এবং সেঁটে বিজ্ঞানীরা নানা দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় উদ্ভাবন করছেন। কিন্তু ব্যথাকে বাইরে থেকে না যায় দেখা, না যায় মাপা। ব্যথা কতটা, তার আন্দাজ করতে চিকিৎসকরা অনেক সময়ে রোগীকে বলেন এক থেকে দশের মধ্যে ব্যথার তীব্রতাকে মাপতে। তবু এক জনের কাছে যা ‘সাত’ তা আর এক জনের ‘পাঁচ’ কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
ব্যথা মানেই ব্যক্তিগত, কাজেই যে সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্মচেতনা-বিজ্ঞানবোধ দিয়ে এক ব্যক্তি গড়ে ওঠে, সে সব কিছুই নির্ধারণ করে তার ব্যথার প্রকাশ। শৈশব থেকে যে দেখেছে, নীরবে ব্যথা সহ্য করাই পৌরুষের পরীক্ষা, কিংবা আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের পরিচয়, তার ব্যথার প্রকাশ হবে এক রকম। আবার নিজের ব্যথা-বেদনার প্রতি সতর্ক ভাবে নজর রাখাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় বলে যে জেনেছে, চিকিৎসকের কাছে প্রতিকার দাবি করতে উৎসাহিত হয়েছে, ব্যথার প্রতি তার মনোভাব হবে আর এক রকম। সংস্কৃতির এই বৈচিত্রকে আরও জটিল করেছে আধুনিক গবেষণা। দেখা গিয়েছে, ব্যথার তীব্রতার অনুভূতি অনেকটা নির্ধারিত হয় মানবশরীরের জিন দিয়ে। কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যথার বোধ শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে তীব্র, মহিলাদের পুরুষদের চেয়ে। বর্ণের পাশাপাশি ব্যথার মাপ ঠিক করে শ্রেণিপরিচয়ও— জনসমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার (ক্রনিক পেন) প্রকোপ দরিদ্রদের মধ্যেই বেশি। তা-ই তো হওয়ার কথা, গরিবের গায়ের ব্যথা কমাতে কে কবে গা করেছে? এ ভাবে ব্যথার অসাম্য সমাজের অসাম্যের বড়ই কাছাকাছি চলে আসে। সংঘাত বেধেছে নৈতিক প্রশ্নেও— যন্ত্রণা প্রকৃতির দান অতএব তার পথ রোধ করা উচিত নয়, এমন একটা ধারণা দীর্ঘ দিন প্রচলিত ছিল। দুঃখের মধ্য দিয়েই সন্তান জন্মাবে, এমন কথাই কি নেই বাইবেলে? এই বিতর্কে শেষ অবধি রাশ টানলেন এক রানি— ভিক্টোরিয়া তাঁর অষ্টম ও নবম সন্তানের প্রসবে ক্লোরোফর্ম ব্যবহারের পর লন্ডনের অভিজাত সমাজে বেদনাহীন প্রসব ফ্যাশন হয়ে উঠল। ব্যথার সমর্থক-বাহিনী পিছু হটল নীরবে।
তা বলে ব্যথা পিছু হটেনি, বরং আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার প্রকোপ। নেতারা পড়ে গিয়েছেন চাপে, এক দিকে মাদকের নিয়ন্ত্রণে ফস্কা গেরো, অন্য দিকে ওষুধের আকাল। আমেরিকা এ বছর নিয়ে পর পর সাত বছর আফিম-ভিত্তিক ব্যথানাশক ওষুধের উৎপাদনের সীমা কমিয়েছে, ভারত তার মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন (২০১৮) করে আরও কঠোর করেছে। মরফিনের অভাবে কত শতসহস্র মানুষ যন্ত্রণাময় মৃত্যু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন, কে বলতে পারে? অনেক চিকিৎসকের দাবি, যত রোগীর আফিম-ভিত্তিক ওষুধ প্রয়োজন, তাদের দশ শতাংশেরও সে ওষুধ মেলে না। সমস্যা কেবল জোগানে নয়। ভারতের হাসপাতালগুলিতে মরফিনের হিসাবপত্রের নথি রাখার নিয়মে এমনই কড়াকড়ি যে, রোগীদের তা সরবরাহের দায় নিতে চান না কেউ। কী করে লাল ফিতের ফাঁস থেকে মুক্ত করা যায় ব্যথাতুর মানুষকে, তার উত্তর খোঁজার দায় অবশ্য কেবল চিকিৎসকদের নয়।