কোনও পরিস্থিতিতেই নাগরিককে যা থেকে রাষ্ট্র বঞ্চিত করতে পারে না, প্রকৃত প্রস্তাবে সেটাই অধিকার। প্রতীকী ছবি।
রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক যা দাবি করে, অথবা কল্যাণরাষ্ট্র নাগরিককে যা দেয়, তার সবটাই ‘নাগরিকের অধিকার’ বলে দেগে দিলে ‘অধিকার’ কথাটি লঘু হয়ে যায়। কোনও পরিস্থিতিতেই নাগরিককে যা থেকে রাষ্ট্র বঞ্চিত করতে পারে না, প্রকৃত প্রস্তাবে সেটাই অধিকার। এই সংজ্ঞা অনুসারেও অবশ্য খাদ্যকে নাগরিকের অধিকার হিসাবে স্বীকার করাই বিধেয়। বলা যেত, আগামী এক বছর দেশে ৮০ কোটিরও বেশি দরিদ্র মানুষকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নাগরিকের সেই অধিকারই স্বীকার করে নিল। খাদ্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে পূর্বতন ইউপিএ সরকার যে পথে হেঁটেছিল, প্রায় এক দশক বিলম্বে হলেও মোদী সরকার উন্নয়নের সেই পথের ধারাবাহিকতা বজায় রাখল। কিন্তু, দু’টি কারণে এই কথা বলা মুশকিল। প্রথমত, সিদ্ধান্তটির মধ্যে ভোটের গন্ধ বড় বেশি প্রকট। প্রধানমন্ত্রী মোদী সাধারণ মানুষের খাদ্যের অধিকারকে গুরুত্ব দেন, অতিমারির ধাক্কা লাগার আগে এমন প্রমাণ খুব একটা মেলেনি। বরং, এই জাতীয় প্রকল্পকে যে তিনি কংগ্রেস জমানার ব্যর্থতার অভিজ্ঞান মনে করেন, সে কথা বলার কারণ আছে। লোকসভা নির্বাচনের মুখে এক বছরের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বণ্টনের সিদ্ধান্তটির পিছনে কল্যাণরাষ্ট্রের কর্তব্য বা নাগরিকের অধিকার সম্বন্ধে বোধ যতখানি, সংশয় হয়, তার চেয়ে বেশি রয়েছে অন্নদাতা হিসাবে আত্মপ্রচারের তাগিদ।
দ্বিতীয় কারণটি নিহিত রয়েছে সরকারের বক্তব্যে। সরকারের মতে, এই সিদ্ধান্ত গরিব মানুষদের প্রতি ‘নতুন বছরের উপহার’। অর্থাৎ, এক বছরের জন্য অন্নের ব্যবস্থা হওয়াকে সরকার নাগরিকের অধিকার হিসাবে নয়, দেখছে সরকারের বদান্যতা হিসাবে। উৎসবের দিনে, ভরসাফুর্তির দিনে প্রজাকে ‘উপহার’ দেওয়া— রাজসমৃদ্ধি থেকে দু’মুঠো খুদকুঁড়ো ছুড়ে দেওয়া প্রজার দিকে— এ অভ্যাস রাজতন্ত্রের, গণতন্ত্রের নয়। অনুমান করা চলে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের মানুষকে নাগরিক নয়, প্রজা জ্ঞান করে। অবশ্য, এ দোষে কেবল কেন্দ্রীয় সরকারই দুষ্ট, বললে অন্যায় হবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তামিলনাড়ু, দিল্লি থেকে ছত্তীসগঢ়, যে রাজ্যের দিকেই চোখ পড়বে, সেখানেই সরকারের ভঙ্গিটি রাজার মতো— কেউ প্রজাকে মাসোহারা দেয়, কেউ মকুব করে দেয় বিজলির বিল। প্রজার অধিকার থাকে না, তার ভরসা শুধু বদান্যতা। ফলে, দেশের সরকারের এই দেখার ভঙ্গি নাগরিকের অধিকারের প্রশ্নটিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়। এই বদান্যতার আয়ু কত? রাজজ্যোতিষী বলতেন, যত ক্ষণ, তত ক্ষণ।
অধিকারের প্রশ্নটিকে ভারতের রাজনৈতিক চর্চার একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে আসা ছিল উন্নয়ন অর্থনীতির পরিসরে মনমোহন সিংহ সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অতি-ব্যবহারে ‘অধিকার’ কথাটির গুরুত্ব সে জমানায় কিঞ্চিৎ লঘু হয়েছিল— কিন্তু, রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের যা প্রাপ্য, তা ক্ষমতাসীন দলের বদান্যতার উপর নির্ভর করে না, সাম্প্রতিক কালে গোটা দুনিয়ায় কোথাও এই কথাটি এত স্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি। গত পৌনে নয় বছর সেই অর্জনকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য শুধু ভারতে নরেন্দ্র মোদীর শাসনেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই কর্তৃত্ববাদী শাসকরা অধিকারের প্রশ্নটিকে সরকারের বদান্যতায় নামিয়ে আনতে পেরেছেন। অতীতেও, আজও। ১৯২০-৩০’এর জার্মানির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির বহু নীতিতে যেমন নাগরিকের প্রতি বদান্যতা ছিল, আজকের তুরস্কে রিসেপ তায়িপ এর্দোয়ানের নীতিতেও রয়েছে। কিন্তু, এই শাসনগুলির কোনওটিই রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের অধিকারের প্রশ্ন স্বীকার করে না। ভারতের ৮০ কোটি গরিব মানুষকে নতুন বছরের উপহার হিসাবে বিনামূল্যে চাল-গম দেওয়ার মধ্যেও সেই অস্বীকারই প্রকট।