— ফাইল চিত্র।
কথিত আছে, আইনের চোখে সকলেই সমান। সেই কথা মানলে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে বিসদৃশ কিছু নেই। তদুপরি, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গত নভেম্বর মাস থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দফায় দফায় সমন পাঠানো সত্ত্বেও অরবিন্দ কেজরীওয়াল তদন্তকারী সংস্থার সামনে নিজেকে হাজির করেননি। নয়া আবগারি নীতি চালু করে তার ‘সুযোগ’ নিয়ে দুর্নীতি করার যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, তার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। লক্ষণীয়, এই অভিযোগে তাঁর একাধিক সহকর্মীকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং লক্ষণীয়, সূচনাপর্বেই দিল্লির আবগারি নীতিতে অসঙ্গতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, যার পরিণামে বছর ঘোরার আগেই সেই নীতি প্রত্যাহৃত হয়। সুতরাং, এই গ্রেফতারিকে অপ্রত্যাশিত বলার কোনও কারণ নেই। ইডি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকরা বলতেই পারেন, এবং বলছেনও, যে— আইন আইনের পথে চলছে।
সমস্যা একটিই। সেই সমস্যার স্বরূপ জানতে চাইলে স্মরণ করা দরকার ২০১৯ সালে সিএএ এবং এনআরসি প্রসঙ্গে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সেই ঐতিহাসিক উক্তি: আগে ‘ক্রোনোলজি’ বুঝে নিন। প্রসঙ্গ যা-ই হোক, কথাটি অত্যন্ত মূল্যবান। ক্রোনোলজি অর্থাৎ ঘটনাপরম্পরা না বুঝলে অনেক ঘটনার নিহিত অর্থ অধরা থেকে যায়। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করতে চাইলে কোন সময়ে কী ঘটছে তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। আইন আইনের পথে চলছে কি না, সেটা জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু আরও জরুরি প্রশ্ন হল: আইন কোন ব্যাপারে কখন ‘আইনের পথে’ চলে, আর কখন অন্য পথে চলে অথবা— পাষাণ অহল্যার মতোই— নিথর নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে, শাপমুক্তির প্রতীক্ষায়। ত্রেতা নয়, এখন ঘোর কলি, সুতরাং সেই প্রতীক্ষা অনন্তকাল অপূর্ণ থেকে যেতে পারে। যেমন, বিরোধী শিবিরের যে নেতার ভদ্রাসনে তদন্তকারীদের হানা দেওয়ার ঘোর সম্ভাবনা ছিল, তিনি রাতারাতি শাসকের খাতায় নাম লেখানোর পরেই সেই সম্ভাবনা ঘোরতর নিদ্রায় নিমগ্ন হতে পারে। আবার, দীর্ঘদিন যে অভিযোগের তদন্তে আইন আইনের পথে ঢিমে তেতালায় চলছিল, রাজনীতির তাওয়া গরম হয়ে উঠলেই সহসা সেই তদন্তের গতি তুঙ্গে ওঠে। ক্রোনোলজি অতি বিষম বস্তু।
কেজরীওয়াল বৃত্তান্তের সাম্প্রতিকতম কাণ্ডের সময় নির্বাচনটি লক্ষ্য করলে এই ঘটনার তাৎপর্য অনুমান করা সহজ। প্রথমত, নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়েছে। কেবল দিল্লিতে নয়, পঞ্জাবে এবং অধুনা গুজরাত নামক খাসতালুকেও আম আদমি পার্টি লোকসভা ভোটে বিজেপির পথের কাঁটা হয়ে উঠেছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে দলনেতাকে প্রচারের ময়দান থেকে সরিয়ে রাখতে পারলে এবং দিল্লি সরকারকে সমস্যায় ফেলতে পারলে দিল্লীশ্বরদের বিশেষ উপকার হয়, সে-কথা বালকেও বুঝবে। কিন্তু শুধু তা-ই নয়। মাহেন্দ্রক্ষণটি হয়তো-বা আরও সুনির্দিষ্ট। সর্বোচ্চ আদালতের চাপে নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত গূঢ় তথ্যগুলি যখন উত্তরোত্তর সামনে আসছে, শাসকের অস্বচ্ছ, অন্যায় এবং অনৈতিক কার্যকলাপের বিভীষণ প্রতিমাটি যখন ভোটদাতাদের দৃষ্টিতে ক্রমশই নিরাবরণ হয়ে পড়ছে, তাঁদের মনে সেই সত্য উদ্ঘাটনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা যখন উত্তরোত্তর জোরদার হয়ে উঠছে, তখন বন্ড কেলেঙ্কারি থেকে তাঁদের দৃষ্টি ও মনকে অন্য দিকে সরানোর জন্য এবং ‘সংবাদ-চক্র’কে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য কেজরীওয়ালের এই গ্রেফতারি কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের জন্য গোয়েন্দা লাগানোর দরকার নেই। শেষ প্রশ্ন: ‘ক্রোনোলজি’র এই খেলাটিকে ভোটদাতারা কী চোখে দেখছেন এবং দেখবেন? আইনের সদ্ব্যবহার হিসাবে না ক্ষমতার অপব্যবহার হিসাবে? এই প্রশ্নের উত্তরের উপরেই ভারতীয় নির্বাচনী গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে।