বিজেপির ‘নবান্ন অভিযান’।
আর বুঝি নীচে নামার উপায় নেই— বঙ্গ-রাজনীতি সম্বন্ধে মানুষ যত বার এই কথাটি ভাবেন, রাজনীতিকরা তাঁদের তত বার অবাক করে দেন, আরও অতলে তলিয়ে গিয়ে। বিজেপির নবান্ন অভিযানই আপাতত বঙ্গ-রাজনীতির নিম্নতম বিন্দু। শুধু এই কারণে নয় যে, অভিযানটির মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর— ঘটনাক্রম বলবে যে, অভিযানের আগাপাছতলা গন্ডগোল পাকানোর অভিসন্ধিদুষ্ট। কিন্তু, ইদানীং রাজনীতির চেহারা এমনই, বঙ্গবাসী এতেই অভ্যস্ত। ফলে, মিছিল করে আসা সমর্থকরা পুলিশের দিকে ইটবৃষ্টি করবেন, কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে মাটিতে ফেলে পেটাবেন, গাড়ি জ্বালিয়ে দেবেন, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করবেন, এর কোনওটিতেই আর অবাক হওয়ার অবকাশ নেই। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, যোগী আদিত্যনাথ-শাসিত উত্তরপ্রদেশে বিরোধীরা যে আচরণ করলে সরকার বিনা প্রশ্নে তাঁদের বাড়িঘরের উপর বুলডোজ়ার চালিয়ে দিচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেতা-কর্মীরা ঠিক সেই আচরণগুলিই করছেন কেন? প্রশ্নটি অবশ্য নিতান্তই আলঙ্কারিক। রাজনীতি যে প্রকৃতপক্ষে এক নিরন্তর আলোচনার পরিসর, এই কথাটি প্রায় সব দলই ভুলে গিয়েছে। বিরোধীদের বাড়ির উপর বুলডোজ়ার চালানো বর্বরতা— সেই আচরণের পুনরাবৃত্তির কোনও প্রশ্নই নেই— কিন্তু, কলকাতার রাজপথে সে দিন যারা পুলিশকে আক্রমণ করল, সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করল, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। প্রকৃত রাজনীতির বোধ যদি জাগ্রত না-ও হয়, শাস্তির ভয় থেকেও আচরণ সংযত হলে মঙ্গল।
কিন্তু, রাজপথের এই হিংস্রতা রাজনীতির সেই অতল নয়। সেই কদর্যতা প্রকাশ পেল ভাষার মাধ্যমে। বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে যে কুৎসিত তরজা চলল, বিশ্বাস করা কঠিন যে সত্যিই রাজ্যের প্রথম সারির রাজনীতিকরা এমন ভাবে ভাবেন, এবং নির্দ্বিধায় সেই কথা উচ্চারণ করতে পারেন। কিন্তু, যা ভাবাও যায় না, রাজনীতি এখন তাকেই হাতেনাতে করে দেখাতে অভ্যস্ত। তৃণমূল কংগ্রেসের সেই কদর্যতার উত্তরে বিজেপি আর এক দফা কদর্যতায় মাতল— বিধানসভার পরিসরেই। যে কথাগুলি উচ্চারিত হল, তার পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক। কিন্তু, তার থেকে যে মনোভাবটি ফুটে উঠল, সে কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা জরুরি। প্রথমত, বোঝা গেল যে, দলমতলিঙ্গনির্বিশেষে অধিকাংশ রাজনীতিকের মনে মনুবাদের আসন অক্ষয়; দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত পরিসরের অনতিক্রম্যতা, বা ব্যক্তিগত আক্রমণ না করার সৌজন্য এখন নিতান্তই বিস্মৃত অতীত। এবং তৃতীয়ত, কিছু কথা মনে ভাবলেও যে প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে নেই, এই বিবেচনাটি এখন অধিকাংশ নেতার মনের পরিসরে ঠাঁই পায় না।
কেউ বলতে পারেন, এ ভাবেই রাজনীতির প্রকৃত গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে— সাধারণ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, ভাবে, রাজনীতিও এখন সেই ভাষাকেই অনুসরণ করছে। বিশেষত এই সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্ফোরণের যুগে নেতা ও অনুগামীর দূরত্ব যে-হেতু বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে, ফলে ভাষা ও চিন্তার মধ্যে দূরত্বও কমেছে। যুক্তিটি একাধিক কারণে দূষিত। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল, ‘নেতা’র কাজ জনগণকে অনুসরণ করা নয়, নেতৃত্ব দেওয়া। সমাজে কলুষ ক্রমবর্ধমান হলে নেতাদের দায়িত্ব আরও বাড়ে— তাঁদের আচরণের মধ্যে দিয়ে বোঝাতে হয় যে, সভ্য সমাজে কোন কথা বা কোন কাজ গ্রহণযোগ্য, আর কোনটি নয়। সভ্যতার অন্যতম শর্ত হল লজ্জা। সুস্থ সামাজিক পরিসরে যে কাজগুলি লজ্জাজনক, শত প্রলোভনেও তাকে এড়িয়ে যেতেই হবে। নচেৎ তৈরি হয় একটি বেহায়া সমাজ। পশ্চিমবঙ্গ এখন যে অতলে দাঁড়িয়ে আছে, তার চতুর্দিকে এই হায়াহীনতার পাঁক।