— ফাইল চিত্র।
নেতা বা মন্ত্রী এক কথা, সরকার আর এক। ভোট এলে নেতা-মন্ত্রীরা সত্য-মিথ্যার মধ্যে ফারাক গুলিয়ে ফেলেন, তা দেখে দেখে ভারতবাসীর এখন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, সরকারেরও কি সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে যাচ্ছে আজকাল? কেন্দ্রীয় সরকার এ মাসের প্রথম দিকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গত দুই দশকের অবস্থা বিষয়ে যে শ্বেতপত্রটি প্রকাশ করেছে, তা হাতে নিলে সেই দুশ্চিন্তা অনিবার্য। প্রশ্ন হল, কী ভাবে বোঝা যাবে যে, শ্বেতপত্রে সরকার যা বলছে, তার সবটা নির্জলা সত্য নয়? তার জন্য প্রাথমিক স্কুলে শেখা পাটিগণিতই যথেষ্ট। যেমন, ৬.৮ এবং ৫.৯-এর মধ্যে কোন সংখ্যাটি বড়? প্রথমটি মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে ইউপিএ শাসনের দশ বছরে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার; দ্বিতীয়টি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ জমানার। পাটিগণিত বলবে, প্রথমটি। শ্বেতপত্র বলছে, ইউপিএ আমলের শেষে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা চূড়ান্ত বেহাল অবস্থায় পৌঁছেছিল; এনডিএ সরকার বহু প্রয়াসে তাকে মেরামত করতে সক্ষম হয়েছে। আঙুলের কড়ে গুনলে দেখা যাবে যে, ইউপিএ সরকারের দশ বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার সাড়ে সাত শতাংশের সীমা অতিক্রম করেছিল ছ’বার; এনডিএ-র দশ বছরে তা করেছে তিন বার, তা-ও তার মধ্যে রয়েছে ২০২১-২২ সালের হিসাব, আগের বছরের আর্থিক সঙ্কোচনের ভয়ঙ্কর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে বছরের আর্থিক বৃদ্ধির হার দেখতে ভাল হয়েছিল। ছয় বেশি, না তিন— অর্থশাস্ত্র না জানলেও বলা যায়।
৫৮ পাতার শ্বেতপত্রটিতে ‘বেকারত্ব’ শব্দটি কোথাও নেই। কেন, তার কারণটি সরকার-প্রকাশিত পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে নামক সমীক্ষায় রয়েছে। সমীক্ষাটি জানিয়েছিল, ২০১৭-১৮ সালে ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছেছিল গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে। তখনও কোভিড অতিমারি ভবিষ্যতের গর্ভে, ফলে সেই ভয়াবহ বেকারত্বের দায় সর্বাংশেই কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সিদ্ধান্তের— যথাক্রমে নোট বাতিল ও অপরিকল্পিত ভঙ্গিতে জিএসটি প্রবর্তন— উপরে বর্তায়। শ্বেতপত্রে এই তথ্যটিও নেই যে, সাধারণ মানুষ কেমন আছেন, তা জানার সব পথই নরেন্দ্র মোদীর সরকার কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৭-১৮ সালের ভোগব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষার ফল সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি— সমীক্ষার ফলাফল ‘ফাঁস’ হওয়ায় জানা গিয়েছিল যে, গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত ভোগব্যয় নাকি কমেছে। তার পর থেকে আর কোনও সমীক্ষা হয়নি— বস্তুত, ভারতে দারিদ্রের পরিমাণ কত, অর্থনীতিবিদদের কাছে তা এখন একটি ধাঁধায় পরিণত হয়েছে, প্রত্যেকেই উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স-এ দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে বলে কেন্দ্রীয় নেতারা যতখানি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, তার অন্তঃসারশূন্যতার কথাও বহুআলোচিত। কিন্তু, শ্বেতপত্রে সেই সমালোচনার উল্লেখ? নৈব নৈব চ।
এমন উদাহরণ শ্বেতপত্রে অসংখ্য। মূল্যস্ফীতির মাপকাঠিতে ইউপিএ সরকারের চেয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থা ‘ভাল’, ফলে সেই প্রসঙ্গে শ্বেতপত্র ছয়লাপ। কিন্তু, যে কথাটি নেই তা হল, মূল্যস্ফীতির পিছনে প্রধানতম অবদান যার, সেই অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের দাম ২০১১ সালে ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১১৫ ডলারে পৌঁছেছিল; ২০১৬ সালে তা ছিল ৪৬ ডলার, ২০২০-তে মাত্র ২০ ডলার। কর্তাদের সম্ভবত ধারণা যে, অর্থনীতির প্রশ্নে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে দেওয়া সহজ— কে আর এত পরিসংখ্যানের পাহাড় ঠেলে সত্যের বিশল্যকরণী খুঁজতে যাবে! কিন্তু, সাধারণ মানুষ দুটো কথা মনে রাখতে পারেন। এক, অর্থনীতির অবস্থা যদি এখন সত্যিই ভাল হত, তবে ইউপিএ সরকারের সঙ্গে তুলনার প্রয়োজন পড়ত না; এবং দুই, অর্থনীতির স্বাস্থ্য বোঝার সেরা মাপকাঠি নিজের আর্থিক অবস্থা— আপনি যদি দশ বছর আগের তুলনায় এখন ভাল না থাকেন, তবে অর্থনীতিও ভাল নেই।