প্রতীকী ছবি।
সরকারের নির্দেশ মানিয়া শেষ অবধি মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার বিতর্কিত অ্যাকাউন্টগুলিকে বন্ধ করিয়া দিল কি না, তাহা তুলনায় গৌণ প্রশ্ন। টুইটার বাণিজ্যিক সংস্থা— ‘আন্দোলনজীবী’ নহে— ফলে, ভারতে সরকারের সহিত চরম সংঘাতে জড়াইয়া এত বড় বাজার খোয়াইতে তাহাদের আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। বস্তুত, বাণিজ্যের এই যুক্তিটি প্রশ্নাতীত রকম স্পষ্ট বলিয়াই কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক এই বিন্দুটিতেই টুইটারের উপর চাপ সৃষ্টি করিয়াছে— ভারতে ব্যবসা করিতে হইলে ‘ভারতের আইন’ মানিয়া চলিতে হইবে, জানাইয়াছেন তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। প্রশ্নটি ‘ভারতের আইন’ লইয়াই। এই দেশের সংবিধান নাগরিকের বাক্স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকার করে। টুইটারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হইতেছে সেই মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করিবার জন্য। ইহাই কি সংবিধানকে সম্মান করিবার প্রকৃষ্ট পন্থা? সেই দার্শনিক প্রশ্ন যদি ছাড়িয়াও দেওয়া হয়, আইনগত ভাবেও কেন্দ্রীয় সরকারের এই অবস্থানটি মজবুত নহে। ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের গণহত্যা করিতেছেন’, এই মর্মে হ্যাশট্যাগ আক্ষরিক অর্থে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর— কেহ বলিতে পারেন, তাহা কুরুচিপূর্ণও বটে। কিন্তু, এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করিয়া টুইট করিবার ‘অপরাধ’-এ কাহারও বাক্স্বাধীনতা হরণ করা আইনসঙ্গত কি না, কেন্দ্রীয় সরকার তাহা জানায় নাই। নিরপেক্ষ বিচারে সরকারের এই অবস্থানটি আইনের ধোপে টিকিত না বলিয়াই সন্দেহ। হয়তো সেই কারণেই ঘুরপথে চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়িল।
এক্ষণে বৃহত্তর প্রশ্নটির সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন— গণতন্ত্রের ভড়ংটুকুও কি আর বজায় রাখিবার প্রয়োজন নাই? গত এক বৎসরেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠিয়াছে যে, তাহারা উগ্র দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের বিদ্বেষমূলক প্রচারের কাজে নিজেদের প্ল্যাটফর্মকে সাগ্রহে ব্যবহৃত হইতে দিয়াছে। সংস্থার অভ্যন্তর হইতে আপত্তি আসিলেও তাহা গ্রাহ্য হয় নাই। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে শোনা গিয়াছে, এই বিদ্বেষে রাশ টানিতে চাহিলে শাসক দলের বিরাগভাজন হইবার সম্ভাবনা। এই কথাটি সত্য কি না, সেই জল্পনার প্রয়োজন নাই; কিন্তু হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষের বেসাতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান কতখানি নরম ছিল, তাহা দেখাই গিয়াছে। কৃষক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে, এবং সেই বিক্ষোভের সমর্থনে, টুইটার ব্যবহৃত হওয়াতে সরকারি প্রতিক্রিয়ার কঠোরতাও দৃশ্যমান। এবং, দুই অবস্থানে এমনই জমিন-আশমান ফারাক যে, আইন-সংবিধান-নৈতিকতা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারের অন্তঃসারশূন্যতা লইয়া কোনও সংশয়ই থাকে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করাই সরকারের উদ্দেশ্য— গণতন্ত্রের আব্রু-রক্ষা নহে।
শাসক দলের, বা সরকারের, অবস্থানের বিরোধী হইলেই যে কেহ ‘দেশদ্রোহী’ হইয়া যায় না, গত সাড়ে ছয় বৎসরে এই কথাটি বহু বার সরকারকে স্মরণ করাইয়া দিতে হইয়াছে। তবুও সরকার এই অবস্থানেই অনড়। রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে ইহা কতখানি বিপজ্জনক, তাহা বাড়াইয়া বলিবার উপায় নাই। ধর্ম, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, প্রাদেশিক পরিচিতি— প্রতিটি অক্ষেই দেশের মধ্যে শত্রু চিহ্নিত করিয়াছে বিজেপি, এবং রাষ্ট্রযন্ত্র সেই শত্রুদমনে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে। টুইটারের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক কঠোরতাও সেই অভিযানেরই অংশ। সরকারপক্ষকে বুঝিতে হইবে, গণতান্ত্রিক পরিসরে এমন বজ্রমুষ্টিতে বিরুদ্ধ স্বরকে দমন করা চলে না। কী ভাবে আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করিতে হয়, কী ভাবে রফাসূত্রে পৌঁছাইতে হয়, সেই রাজনৈতিক কৌশল তাহাদের আয়ত্ত করিতে হইবে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের চালকের আসনে বসিয়াও যদি তাঁহারা গণতন্ত্রকে সম্মান করিতে না শিখেন, তবে তাহা অতি লজ্জার, অতি দুঃখের।