—প্রতীকী চিত্র।
সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারেই হোক বা ব্যস্ত পাড়ার গলির মোড়ে, কোনও তুলনাহীনাকে দেখে ‘ডার্লিং’ বলে ডাকা সমীচীন তো নয়ই, বরং দণ্ডনীয় অপরাধ— সম্প্রতি এক রায়ে জানাল কলকাতা হাই কোর্ট। আন্দামানে কয়েক বছর আগে এমন এক ঘটনায় এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় যৌন হেনস্থা ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের হয়, কর্তব্যরত এক মহিলা পুলিশ কনস্টেবলকে তিনি ‘ডার্লিং’ বলে ডেকেছিলেন। নিম্ন আদালতে বিচারের রায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে গেলে, কলকাতা হাই কোর্টের পোর্ট ব্লেয়ার সার্কিট বেঞ্চ অভিযুক্তের কারাদণ্ড কমিয়েছে বটে, তবে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী এ যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মাননীয় বিচারপতি।
অপরাধ ও শাস্তির আইনি কার্য-কারণ সম্পর্কের বাইরেও এই রায় ও তার পর্যবেক্ষণটি জরুরি, কারণ তা সমাজে বা জনপরিসরে নাগরিক কী ভাবে আচরণ করবেন, বিশেষত মেয়েদের সঙ্গে, সে দিকটি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সহজ স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেয়, অপরিচিত কাউকেই— তিনি পুরুষই হোন কি নারী— এমন কোনও শব্দে সম্বোধন করা যায় না যাতে তাঁর সম্মানহানি হয়, বা তিনি বিরক্ত বা বিপন্ন বোধ করেন। অথচ এমন ঘটনাই ঘটে চলেছে চার পাশে নিরন্তর, মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে— পাড়ার মোড়, চা-দোকান, ক্লাব বা মাঠের জটলা থেকে উড়ে আসে এমন সব অবাঞ্ছিত সম্বোধন, মন্তব্য বা গানের কলি যা অপরিচিতার অস্বস্তি উদ্রেক করে, অনেক সময় নিরাপত্তার আশঙ্কাও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা এগুলি এড়িয়ে এবং তড়িঘড়ি জায়গাটিও পেরিয়ে যান, কারণ এত দিনে তাঁদের জানা হয়ে গেছে যে, জন-আচরণ প্রধানত এ রকমই হয়ে থাকে, এই একুশ শতকেও। প্রতিবাদ যে হয় না তা নয়, তাতে যে কাজও হয় না এমনও নয়, কিন্তু সেই সবই ব্যতিক্রম, আন্দামানের ঘটনাই আসলে চার পাশের যাপিত সত্য।
পরিচিত বা অপরিচিতের প্রতি সম্বোধন জাতি ও সংস্কৃতিভেদে আলাদা; পরিস্থিতির লঘুতা বা গাম্ভীর্যের উপরেও তা নির্ভরশীল। ‘ডিয়ার’ বিলেতে নিতান্ত কেজো সম্বোধন, কিন্তু ভারতে তার প্রয়োগ প্রগল্ভতা বলে নিন্দিত হতে পারে। দরখাস্তে অধস্তন কর্মীর ‘ডিয়ার’ সম্বোধনে উপরওয়ালা নাখোশ হয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে। ‘ডার্লিং’-এর নিহিত ভাবটি প্রেমের তা সবার জানা, সে কারণেই এও বোঝা দরকার যে, প্রথম সাক্ষাতেই কাউকে এ শব্দে বরণ করা চলে না, এমনকি মজার ছলেও নয়, টিভি-সিনেমার পর্দায় অহরহ তা দেখা গেলেও নয়। আন্দামানের অভিযুক্তের কৌঁসুলিরা আদালতে এই যুক্তি দিয়েছিলেন যে, জনপরিসরে কথোপকথনে এমন শব্দ প্রায়ই শোনা যায়, সিনেমাতেও ব্যবহার হয়— যৌন অনুষঙ্গ ছাড়াই। মাননীয় বিচারক তা খারিজ করে আর একটি জরুরি কথা বলেছেন, ভারতের সমাজ এখনও তেমন অবস্থায় পৌঁছয়নি যে, প্রকাশ্যে কোনও অপরিচিতার প্রতি কেউ সানন্দে এ শব্দ প্রয়োগ করবে; অভিযুক্ত নেহাত অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় শব্দটি বলেছে এবং এক বার বলেই থেমে গিয়েছে, নয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় তার উচ্চারণ কঠোরতর শাস্তি ডেকে আনত। রসিকতা কখন অনধিকার হয়ে যায়, আপাত-সুন্দর শব্দও কখন বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সেই শিক্ষার অভাব রয়েছে। অবিলম্বে তা শেখা দরকার।