প্রতীকী ছবি।
মামলার পাহাড় জমিতেছে পশ্চিমবঙ্গের আদালতে। নিম্ন আদালতে মামলা জমিয়া থাকা এবং বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হইবার অভিযোগটি পুরাতন, অতিমারিতে তাহা ভিন্ন মাত্রা লাভ করিয়াছে। ফৌজদারি মামলার বিচার পর্বে বহু সাক্ষ্য ও নথি পেশ করিবার প্রয়োজন হয়। ভার্চুয়াল মাধ্যমে কী ভাবে তাহা হইবে, এখনও সেই বিধি স্থির হয় নাই। অতএব, কালবিলম্ব চলিতেছে। অভিজ্ঞতা বলিবে যে, সমস্যার স্বরূপ পাল্টাইয়া যায়, বিলম্ব চলিতেই থাকে— আপাতত তাহা সাইবার-সরণি বাহিয়া আসিয়াছে। এই বিলম্বে বিচারপ্রার্থীদেরই সর্বাধিক ক্ষতি, তাই বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও একটি প্রশ্ন তুলিতেই হয়: কোনও মামলার এক যুগ কাটিয়া যাইবার পর রায় আসিলে কি তাহাকে সুবিচার বলা চলে? যে বৃদ্ধা মা তাঁহার পুত্রকে হারাইবার পর বিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন, তাঁহাকে বহু বৎসর যাবৎ কেবল তারিখের আবর্তে ঘুরিতে হইলে কি সুবিচারের যাথার্থ্যটি লঘু হইয়া যায় না? সুতরাং, সমস্যা যাহাই হউক, সমাধান খুঁজিয়া মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করাই অগ্রাধিকার হওয়া বিধেয়।
এবংবিধ সমস্যাকে যদিও আদালত-নির্দিষ্ট অথবা রাজ্যনির্দিষ্ট ভাবিলে ভ্রম হইবে। ইহার বীজ বিচারব্যবস্থার গভীরে নিহিত। কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ভারতে দশ লক্ষ জনতা পিছু বিচারপতির সংখ্যা কুড়ি। তুলনামূলক হিসাব বলিবে, ব্রিটেনে সংখ্যাটি ৫১, আমেরিকায় ১০৭। কয়েক বৎসর পূর্বে সমগ্র দেশে প্রায় ছয় সহস্র বিচারকের শূন্যপদের কথা জানাইয়াছিলেন আইনমন্ত্রী। এই দ্বিমুখী ঘাটতিই— এক দিকে বিচারপতি পদের সংখ্যাল্পতা, অপর দিকে তাহাও যথাকালে পূরণ না হওয়া— ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে দীর্ঘসূত্র করিয়া তুলিয়াছে। বিচারপতি ভি ভি রাও হিসাব কষিয়াছিলেন, ভারতের বিভিন্ন আদালতে ঝুলিয়া থাকা সকল মামলা শেষ করিতে সময় লাগিবে ৩২০ বৎসর। বিশেষজ্ঞদের মত, কোনও বিচারব্যবস্থার পক্ষেই এতাদৃশ অতিরিক্ত বোঝা বহন করিয়া দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব নহে। এবং, ইহার ফলেই নানা কালে নানাবিধ সমস্যা— যেমন বর্তমানে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সাক্ষ্য, নথি ইত্যাদি প্রদর্শন— বড় হইয়া দেখা দিতেছে।
সঙ্কট দ্বিবিধ— সমাধানও। প্রথমত, যথাশীঘ্র এই বিপুল সংখ্যক শূন্যপদ পূরণ হওয়া প্রয়োজন। কয়েক বৎসর পূর্বে শূন্যপদ পূরণে সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও সময়সীমার কথা জানাইয়াছিল হাই কোর্ট ও রাজ্য সরকারগুলিকে। অদ্যাবধি তাহা অনুসৃত হয় নাই। দ্বিতীয়ত, বিচারপতির পদ বৃদ্ধি করা। ১৯৮৭ সালে, কেন্দ্রীয় আইন কমিশনের ১২০তম রিপোর্টে বলা হইয়াছিল, ভারতে প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় অন্তত ৫০ জন বিচারপতি থাকা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত, ভারতে প্রতি বৎসর গড়ে দুই কোটি মামলা হইয়া থাকে। ইদানীং তাহার নিষ্পত্তির গতি ধীর হইতে ধীরতর হইতেছে। ইহাও ভুলিলে চলিবে না যে, সংখ্যার অপ্রতুলতার জন্য কেবল বিচারব্যবস্থাকে দোষারোপ করিয়া লাভ নাই, নিয়োগকারী হিসাবে সরকারকেও গাত্রোত্থান করিতে হইবে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক বক্তৃতায় তাহা স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর। পাঁচ বৎসর কাটিতে চলিল— ঘুম কি ভাঙিবে না?