উদ্ধব ঠাকরে (বাঁ দিকে) এবং একনাথ শিন্দে (ডান দিকে)। ফাইল ছবি।
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি করতে অস্বীকার করল সুপ্রিম কোর্ট। অতএব ধরে নেওয়া চলে যে, এ যাত্রায় একনাথ শিন্দের কাছে পরাজয় স্বীকার করা ভিন্ন উদ্ধব ঠাকরের গত্যন্তর নেই। শিবসেনা দলটির নাম এবং নির্বাচনী প্রতীক, কমিশনের নির্দেশে উভয়ই একনাথ শিন্দে গোষ্ঠীর হস্তগত হল। নির্বাচনী রাজনীতিতে দলের নাম ও প্রতীকের গুরুত্ব কতখানি, তা সম্ভবত বাড়িয়ে বলার উপায় নেই। ভারতের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশের কাছে দলীয় নীতি, গণতন্ত্রের গতি বা সংবিধানের নির্দেশ, কিছুই বিশেষ কোনও অর্থ বহন করে না— তাঁরা দলের নাম ও প্রতীকটুকুই জানেন। ফলে, মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে গত ষাট বছরে শিবসেনা যে রাজনৈতিক মূলধন গড়তে পেরেছিল, শিন্দে তার সিংহভাগের মালিকানা পেলেন। নির্বাচন কমিশন যে পদ্ধতিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল, তা নিয়ে কিছু তর্ক আছে। আইনসভায় শিন্দে-পন্থীরা সংখ্যাগুরু, এই যুক্তির ভিত্তিতে দলের নাম ও প্রতীক সেই গোষ্ঠীকে দেওয়ায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি ধরে নেওয়া যায় যে, যাঁরা দলত্যাগ করলেন, তাঁরা দলীয় প্রতীকে ভোট দেওয়া নাগরিকদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করবেন? এবং, নাগরিকরা ভোট দিয়েছিলেন এই ব্যক্তিদেরই, অখণ্ড দলটিকে নয়?
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে, এ ক্ষেত্রে তারা ১৯৭২ সালের সাদিক আলি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তৈরি করা ত্রিস্তরীয় নির্দেশিকা অনুসরণ করেছে। এই নির্দেশিকা অনুসারে, কোনও রাজনৈতিক দলের দুই বা ততোধিক গোষ্ঠীর মধ্যে দলের অধিকার বিষয়ক বিরোধ তৈরি হলে প্রথমে বিবেচ্য, গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আদর্শগত ভাবে কোনটি মূল দলের নিকটতর। এ ক্ষেত্রে এই মাপকাঠিতে ঠাকরে গোষ্ঠী ও শিন্দে গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও ফারাক করা যায়নি— উভয় গোষ্ঠীই জানিয়েছে যে, তারা শিবসেনার রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি অনুগত। দ্বিতীয় ধাপটি হল, মূল দলের সংবিধান অনুসারে বিচার করা যে, কোন গোষ্ঠী সেই দলের অধিকার পেতে পারে। শিবসেনার ক্ষেত্রে এই ধাপটি কার্যকর হয়নি, কারণ ২০১৮ সালে শিবসেনার দলীয় সংবিধানে যে সংশোধন করা হয়েছিল, তা নির্বাচন কমিশনের মতে অগণতান্ত্রিক, ফলে অবৈধ। তৃতীয় ধাপটি হল, দলের অভ্যন্তরীণ সংগঠনে কোন গোষ্ঠী সংখ্যাগুরু, তা বিচার করা। কিন্তু, দলীয় সংবিধানটি অবৈধ বিবেচিত হওয়ার ফলে এই ধাপটিও বাতিল হয়ে যায়। ফলে, নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে, আইনসভায় দুই গোষ্ঠীর তুলনামূলক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিবেচনা করা ভিন্ন আর উপায় ছিল না। কমিশনের এই অবস্থানটি তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতীয় রাজনীতিতে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্নটি যখন ক্রমেই অলীক হয়ে উঠছে, তখন শিবসেনার দলীয় অধিকারের প্রশ্নে এই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের মাপকাঠির ব্যবহার শুধুমাত্র এককালীন, না কি ভবিষ্যতে অন্য দলের ক্ষেত্রেও তার প্রতিধ্বনি শোনা যেতে পারে, সেই প্রশ্ন অবশ্য থাকছে।
কংগ্রেস তো বটেই, ভারতে কার্যত সব আঞ্চলিক দলেই পরিবারতন্ত্র এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। শিবসেনাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মহারাষ্ট্রের জনমানসে তার পরিচিতি বালাসাহেব ঠাকরের দল হিসাবেই— ফলে, পরিবারতন্ত্রের প্রথা অনুসরণ করলে তাঁর পুত্র উদ্ধব এবং তস্য পুত্র আদিত্যেরই এই দলের ‘স্বাভাবিক’ নেতা হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কথা। একনাথ শিন্দে গোষ্ঠীর হাতে দলের নাম ও প্রতীকের অধিকার তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটিকে একটি নতুন সম্ভাবনার পরিসর হিসাবেও দেখা যেতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক দল কোনও পরিবারের সম্পত্তি নয়; দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যে বংশানুক্রমেই হস্তান্তরিত হবে, এমন কোনও কথাও নেই। ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি সম্ভাবনা আক্ষরিক অর্থেই যুগান্তকারী হতে পারে।