George Soros

পর্যবেক্ষক

জর্জ সোরোস অ-ভারতীয়, অতএব তাঁর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকার নেই, এই যুক্তিটি পরিচিত। এবং গোলমেলে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৩ ০৫:০৮
Share:

আমেরিকান লগ্নিকারী জর্জ সোরোস। ফাইল চিত্র।

আমেরিকান লগ্নিকারী জর্জ সোরোস-এর উপরে মর্মান্তিক চটেছেন বিজেপি নেতারা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, সোরোস আসলে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষতি চান; তাঁর স্বার্থ রক্ষা করবে, কেন্দ্রে এমন কোনও সরকার প্রতিষ্ঠা করতেই তাঁর এই সক্রিয়তা। সোরোসের দোষ, আদানি-কাণ্ডে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দিকেও আঙুল তুলেছেন। বলেছেন, এই লগ্নিকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ, ফলে জবাব দেওয়ার দায় প্রধানমন্ত্রীর উপরেও বর্তায় বইকি। এবং আশাপ্রকাশ করেছেন যে, সেই জবাবদিহির প্রক্রিয়াই ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবে, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুপবন বইবে, এবং শেষ অবধি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। সোরোসের একটি কথারও আদৌ কোনও ভিত্তি আছে কি না, ভারতীয় গণতন্ত্র সম্বন্ধে তাঁর ধারণা কতখানি ক্ষীণ, সব প্রশ্নই চলতে পারে। কিন্তু, কোনও বিদেশি নাগরিক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিন্দা করেছেন মানেই তিনি দেশের শাসনব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলতে চাইছেন, বা তা ভারতের শাসনক্ষমতা পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র, এমন কথা বললে তা হাস্যকর হয়। অথবা, তার অধিক— এই প্রতিক্রিয়া ভারতীয় শাসকদের অসহিষ্ণুতাকে যেমন স্পষ্ট করে দেয়, তেমনই উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগকে ব্যবহারের প্রবণতার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

Advertisement

ভারতে গণতন্ত্র বা তার অভাব নিয়ে বিশ্বমঞ্চে উদ্বেগ ক্রমেই প্রকটতর হচ্ছে। সে উদ্বেগ নিছক পরহিতৈষণাসঞ্জাত নয়। লগ্নি প্রত্যক্ষ ভাবে গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করে না বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের অভাব যদি শেষ অবধি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করে, অথবা দেশে অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসের পরিমাণ হ্রাস করে, তবে তা লগ্নির জন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। লগ্নিকারী হিসাবে জর্জ সোরোস খ্যাতনামা। ফলে, তাঁর উদ্বেগ যদি তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূতও হয়ে থাকে, তবুও তাকে প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয় ছিল। কিন্তু, তার বদলে সোরোসকে ব্যক্তি-আক্রমণ করে, তাঁর বক্তব্যের উপরে অভিসন্ধি আরোপ করে বিজেপি নেতৃত্ব যে বার্তাটি দিলেন, তা হল, রাজনৈতিক আনুগত্য ব্যতীত ভারতে ব্যবসা করা কঠিন হবে। বিশ্ব-পুঁজিকে এই বার্তা দেওয়ার মধ্যে যে বিচক্ষণতার সবিশেষ অভাব রয়েছে, স্মৃতি ইরানিরা কি সে কথা বুঝতে অক্ষম? না কি, বুঝেও তাঁরা নাচার?

জর্জ সোরোস অ-ভারতীয়, অতএব তাঁর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকার নেই, এই যুক্তিটি পরিচিত। এবং গোলমেলে। গণতন্ত্রের পরিসরে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব অসীম। এমন ব্যক্তি, সেই নির্দিষ্ট পরিসরটিতে যাঁর কোনও প্রত্যক্ষ স্বার্থ নেই, তাঁর পর্যবেক্ষণে ন্যায়-অন্যায় ধরা পড়ে অনেক সহজে, স্পষ্ট ভাবে। ঠিক যে কারণে কোনও দেশে সংখ্যালঘুদের দুরবস্থা বিষয়ে মন্তব্য করার, উদ্বেগ প্রকাশ করার অধিকার গোটা দুনিয়ার নাগরিকের রয়েছে, ইরানে নাগরিক আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নিন্দা করার অধিকার আছে, তেমনই ভারতীয় গণতন্ত্র সম্বন্ধেও মন্তব্য করার অধিকার সর্বজনীন। সেই মন্তব্য থেকে শিক্ষা নেওয়া, অথবা তার সঙ্গে সংলাপে যাওয়া বিচক্ষণতার কাজ। উগ্র জাতীয়তাবাদের অস্ত্রে তাকে খণ্ডন করার প্রচেষ্টাকে কিছু গোপন করার তাড়না বোধ হওয়া অসঙ্গত নয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement