মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কার্যত সব বাণিজ্য সম্মেলনেই যত টাকার লগ্নিপ্রস্তাব আসে, যত সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়, প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ তার চেয়ে অনেকখানি কম হয়। যে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ সম্মেলনের হাত ধরে রাজ্যে রাজ্যে বাণিজ্য সম্মেলনের ঢল নামে ভারতে, তার জন্যও কথাটি সত্য। আসল প্রশ্ন হল, প্রস্তাবের সঙ্গে প্রকৃত বিনিয়োগের ফারাক কতখানি? পশ্চিমবঙ্গে বছরের পর বছর বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন হয়ে যায়, কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না। বিরোধীরা এ বারও প্রশ্নটি তুলেছেন। গত বছর জানা গিয়েছিল, মোট লগ্নিপ্রস্তাব এসেছে ৩,৪২,৩৭৫ কোটি টাকার; এ বছরের সংবাদ, অঙ্কটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,৭৬,২৮৮ কোটি টাকা। বৃদ্ধি প্রায় দশ শতাংশ— মূল্যস্ফীতির পরিমাণ বাদ দিলেও প্রকৃত বৃদ্ধি বাবদ কিছু পড়ে থাকবে। কিন্তু, স্বপ্নে রাঁধা পোলাওয়ে যতই ঘি পড়ুক, তাতে কী লাভ? অতএব, পোলাও যে সত্যিই উনুনে চাপানো হয়েছে, তার কিছু প্রমাণ পেশ করা প্রয়োজন। গত বছর বা তার আগের বাণিজ্য সম্মেলনে প্রস্তাবিত লগ্নির মধ্যে কয়টি ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে, বা অন্তত কাজ এগিয়েছে খানিক দূর, সেই তথ্য পেশ করার দায় রাজ্য সরকারের উপর বর্তায় বইকি। সরকার লগ্নি টানার জন্য কী করছে, সে তথ্যও চাই। ভারতের বহু রাজ্য গত কয়েক বছরে নতুন বাণিজ্য নীতি প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সে কথা ভাবছে কি না, অন্তত এই রাজ্যের পরিচালকরা কোন বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করছেন, তা জানা প্রয়োজন। নচেৎ, বাণিজ্য সম্মেলনকে বাৎসরিক মোচ্ছবের বেশি কিছু ভাবা মুশকিল।
কেন পশ্চিমবঙ্গ শিল্পের পক্ষে অনুকূল, এই প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই রাজ্য সবাইকে নিয়ে চলতে জানে, এখানে ভেদাভেদ নেই। তাঁর ইঙ্গিত কেন্দ্রীয় শাসকদের প্রকট ধর্মীয় বিভেদনীতির দিকে। অস্বীকার করা চলে না যে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এখনও উজ্জ্বল। এবং, এ কথাও অনস্বীকার্য যে, দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এই সুস্থ নীতির কোনও বিকল্প নেই। অর্থনীতিবিদরা বারে বারেই আর্থিক বৃদ্ধির জন্য সামাজিক আস্থার গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দেন। তার একটি অপরিহার্য দিক সরকারের সমদৃষ্টি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সাম্প্রদায়িক বিভেদই তো বিভেদের একমাত্র রূপ নয়। পশ্চিমবঙ্গের সমাজের দীর্ঘমেয়াদি এবং সর্বাধিক অভিঘাতসম্পন্ন বিভাজনরেখাটি রাজনৈতিক— এ রাজ্য রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত, এবং সেই বিভাজনই এই রাজ্যে বিদ্বেষের সবচেয়ে বড় উৎস। তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে সেই বিভেদ কমেছে, এমন দাবি সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীও করবেন না। সেই বিদ্বেষ পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত করে রাখে— যে অশান্তি শিল্পের পক্ষে অনুকূল নয়। সত্যিই যদি শিল্পবান্ধব পরিবেশ নির্মাণের সদিচ্ছা থাকে, তবে এ দিকে নজর না দিয়ে উপায় নেই।
শুধু সম্প্রীতির জোরে অবশ্য শিল্প হয় না। তার জন্য অনেক কিছু চাই— সবচেয়ে বেশি চাই লগ্নির নিরাপত্তা। এক কালে বামপন্থীদের কল্যাণে জঙ্গি শ্রমিক রাজনীতি এ রাজ্যে শিল্পশ্মশান রচনা করেছিল। এখন শিল্পও নেই, ফলে তার দরজা আটকে লাল পতাকার শবসাধনাও নেই। কিন্তু সিন্ডিকেট আছে, তোলাবাজি আছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আছে। সবচেয়ে বেশি আছে সেই বেয়াদবির প্রতি রাজনৈতিক প্রশ্রয়। আছে শিল্পের জমি নিয়ে অনিশ্চয়তাও। যদি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন কাঙ্ক্ষিত হয়, তবে এ সমস্যার সমাধান করতেই হবে। এ বারের লগ্নিপ্রস্তাবে যে ক্ষেত্রগুলি গুরুত্ব পেয়েছে, তার প্রতিটিতেই পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধি-সম্ভাবনা যথেষ্ট। শিক্ষা বা তথ্যপ্রযুক্তির মতো বাণিজ্যে ক্ষেত্র প্রস্তুতই আছে, পর্যটন বা স্বাস্থ্যও নেহাত পিছিয়ে নেই। কিন্তু, লগ্নিকারীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা গেলে সেই সম্ভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বিশেষ সময় লাগবে না।