—প্রতীকী চিত্র।
কাশ্মীর আবারও জাতীয় মানচিত্রে একটি নতুন বিতর্ক তৈরি করতে চলেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ তদারকিতে। কী সেই বিতর্ক, তার অন্দরে যাওয়ার আগে একটি কথা স্মরণ করে নেওয়া কর্তব্য। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির পরিসরে যে বিষয়গুলি দিয়ে জাতীয়তাবাদের আবেগ-ধুনুচি নিশ্চিত ভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া যায়, তার মধ্যে কাশ্মীর অঞ্চলটি অন্যতম। এবং জাতীয়তাবাদ যে-হেতু আগামী কয়েক মাসে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের কাছে একটি অতি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হয়ে উঠতে চলেছে— আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের দিকে নজর রেখে— কেন আবার কাশ্মীর, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হাতড়ে বেড়ানোর দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যুগপৎ একটি বিষয়ে নিজেদের অসামান্য দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে চলেন, তা হল সময়জ্ঞান। কোন সময়ে কোন কাজটি করলে তার থেকে সর্বাধিক ফল লাভ করা যাবে, সব রাজনীতিই সেই হিসাব করে চলে। কিন্তু মোদী-শাহ জুটির ধারেকাছে পৌঁছনোর ‘যোগ্যতা’ খুব বেশি কেউ রাখেন না। ফলত ঠিক সময় বুঝে কাশ্মীর নিয়ে চার-চারটি বিল সম্প্রতি আইনসভায় এসে পৌঁছল, যাদের মূল উদ্দেশ্য ও বিধেয়, সেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া, এবং অঞ্চলটির চরিত্রে বড় মাপের পরিবর্তন নিশ্চিত করা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ‘জম্মু ও কাশ্মীর তফসিলভুক্ত জনজাতি সংরক্ষণ (সংশোধনী), ২০২৩’ বিলটি।
সংবিধানের তফসিলভুক্ত জনজাতির যে তালিকা রয়েছে, সেটা ঠিক জাতীয় তালিকা নয়, বরং প্রদেশভিত্তিক কিংবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলভিত্তিক। সুতরাং কোনও অঞ্চলের জনজাতি কে বা কারা, তার হিসাব একমাত্র সম্ভব সেই অঞ্চলের শাসনভার যাদের উপর তাদের পরামর্শক্রমে। হরিয়ানা, পঞ্জাব, দিল্লি বা পুদুচেরির ক্ষেত্রে এমন তালিকা নেই, যেমন ছিল না ১৯৮৯ সালের আগে জম্মু ও কাশ্মীরেও। ১৯৮৯ সালে সেখানে প্রথম বার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি হয়, যেটি ১৯৯১ সালে সংশোধিত হয়। সেই তালিকাই এ বার সংসদে নতুন ভাবে সংশোধিত হল, যার মধ্যে চারটি নতুন জনজাতির নাম যুক্ত হয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়াল ১৬। ধরে নেওয়া যেতে পারে, এর ফলে এই জনজাতির সমর্থন পাবে বিজেপি, এবং সেখানে ভোট হলে জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার ৯০টি আসনের মধ্যে সংরক্ষিত আসনগুলি আসবে বিজেপির কোলে। এমনিতেই ডিলিমিটেশনের ফলে জম্মুর আসনসংখ্যা অনেকাংশে বাড়বে, কাশ্মীরের আসনসংখ্যা কমবে। তার মধ্যে নবসংরক্ষিত পাহাড়ি, গুজ্জর, পাদ্দারি, নাগসেনা জনজাতির সমর্থন ক্ষমতার ভারসাম্য আরও হেলিয়ে দিতে সক্ষম হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
সমস্যা এখানেই। সংরক্ষণ একটি সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার কে কতটা পেতে পারে, তার বিচার একটি জটিল সমাজতাত্ত্বিক, ইতিহাসভিত্তিক পদ্ধতি হওয়ার কথা, ভোট পাওয়ার ছলাকলা হওয়ার কথা নয়। ভারতীয় রাজনীতিতে ‘নির্বাচনী এঞ্জিনিয়ারিং’-এর প্রবণতার চোটে, আঞ্চলিক জনজাতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণকে এমন এক অস্ত্র ধরে নিয়ে বিজেপি একাধিক ক্ষেত্রে তার ব্যবহার ঘটিয়ে চলেছে। সর্বত্র যে সুফল মেলেনি, মণিপুর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বাস্তবিক, মণিপুরের ঘটনা বুঝিয়ে দিতে পারে যে সংরক্ষণের এই অসম্ভব জোরদার অস্ত্রটি নির্বিচারে ব্যবহার করলে তা আক্ষরিক অর্থে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে, গোটা জনসমাজকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। বিজেপি অবশ্যই সেই পাঠ গ্রহণ করেনি, করতে চায়নি। মণিপুর অধ্যায়ের পর তাই শুরু হতে চলেছে সংরক্ষণ-যজ্ঞের কাশ্মীর অধ্যায়। ভারতে এত সংখ্যক জনজাতি, এবং তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানে এত প্রভূত বৈচিত্র ও জটিলতা যে এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থনিষিক্ত নির্বাচনী এঞ্জিনিয়ারিং দেশ জুড়ে বিশাল, ব্যাপ্ত, গভীর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ডেকে আনছে।