— ফাইল চিত্র।
জর্জ অরওয়েল তাঁর অ্যানিম্যাল ফার্ম-এ জানিয়েছিলেন, সব পশুই সমান, কিন্তু কোনও কোনও পশু অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সমান। দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তেই সর্বাধিপত্যকামী শাসনের ‘ইউজ়ার ম্যানুয়াল’ বলা যেতে পারে অরওয়েলের উপন্যাসদ্বয়কে। ভারতে এই নির্বাচনী ঋতুতে বিজেপির প্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি নির্বাচন কমিশনের ভঙ্গি দেখলে মনে হয়, তারাও বুঝি অরওয়েলের উপন্যাসের পাতা থেকেই রাজর্ধমে শিক্ষা নিয়েছে। সপ্তাহদুয়েক আগে দেশের কোটি কোটি মানুষের মোবাইল ফোনে একটি সরকারি বার্তা পৌঁছল— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই বার্তায় দেশবাসীকে ‘বিকশিত ভারত’-এর কথা শুনিয়েছেন, সেই স্বর্গে উপনীত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন মানুষকে। যে দেশে আর্থিক অসাম্যের মাত্রা ঔপনিবেশিক আমলের চেয়েও বেশি, যে দেশের তরুণদের প্রতি চার জনে এক জন বেকার, সে দেশকে ‘বিকশিত’ আখ্যা দেওয়া কতখানি যুক্তিসঙ্গত, সে প্রশ্ন অন্যত্র। কিন্তু, আদর্শ নির্বাচনী বিধি ঘোষিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞাপন করতে পারে, সেই প্রশ্নটি অপরিহার্য। বিরোধীরা প্রশ্নটি তুলেছেন। নির্বাচন কমিশন একেবারে কিছুই করেনি, বললে অন্যায় হবে— কমিশন কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফর্মেশন টেকনলজি মন্ত্রকের সচিবকে ডেকে বলেছে, আর যেন কখনও এমন ভুল না হয়। কে জানে, হয়তো ‘খুব দুষ্টু হয়েছ’ বলেও বকুনি দিয়েছিল কমিশন। তবে, আদর্শ নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের কোনও অভিযোগেই কমিশন এর চেয়ে বেশি কঠোর হয় না, সে কথা বললে মিথ্যাচার হবে। এই আইনে জেল হয়, জরিমানা হয়, নির্বাচনে লড়ার অধিকার কেড়ে নেওয়াও হয়। তবে কিনা, কমিশনের চোখে কেউ যদি অন্যদের চেয়ে ‘বেশি সমান’ হন, তাঁর ক্ষেত্রে মৃদু তিরস্কারও সম্ভবত অনেক।
আশঙ্কা হয়, এই কথাটি প্রধানমন্ত্রীও বিলক্ষণ জানেন। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে ফোনালাপটি প্রকাশ্যে আনলেন পশ্চিমবঙ্গের এক বিজেপি প্রার্থী। জানা গেল, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন যে তিনি ভোটের প্রচারে বেরিয়ে মানুষকে বলুন, এ রাজ্যে ইডি যে টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে, মোদীজি সে টাকা মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার পথ খুঁজছেন। গত দশ বছর ধরে যাঁরা অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা এবং জীবনে ‘অচ্ছে দিন’-এর অপেক্ষা করছেন, তাঁরা হঠাৎ ‘মোদীজি’র এ-হেন প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করবেন কেন, তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীর আসনটিকে ব্যবহার করে এ-হেন প্রতিশ্রুতি প্রদান কি নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ নয়? বিরোধীদের তেমনই অভিযোগ। আশঙ্কা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত জানেন, বিধি ভঙ্গ করলেও তাঁর কোনও সমস্যা নেই— নির্বাচন কমিশন সস্নেহে তাকে উপেক্ষা করবে। এ তো আর ১৯৭৫ সাল নয় যে, বিধি ভঙ্গের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ থেকে ছ’বছরের জন্য বহিষ্কার হতে হবে!
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের অভিযোগ এই প্রথম নয়— ২০১৯ সালেও অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি নির্বাচনী প্রচারের বয়ান প্রস্তুত করতে সরকারি আমলাদের ব্যবহার করছেন। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ চরিত্রগত ভাবে তার সঙ্গে সমতুল। এ বছরও নির্বাচনী প্রচারে বায়ুসেনার হেলিকপ্টার ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। তালিকা দীর্ঘতর করা অনর্থক। নির্বাচন কমিশন যদি কোনও এক নির্দিষ্ট প্রার্থীর প্রতি, বা কোনও দলের প্রতি, পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তবে তা অতি ভয়ঙ্কর। অবাধ নির্বাচন গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত। নির্বাচন পরিচালনার গুরুভার যে প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত, তা যদি কোনও পক্ষের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তবে সেই শর্ত লঙ্ঘিত হয়। গত এক দশকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভিতে যে ক্ষয়ের সাক্ষী থেকেছে ভারত, নির্বাচন কমিশনও যদি সেই ভাঙনের শরিক হয়, তা অপূরণীয় ক্ষতি হবে।