—ফাইল চিত্র।
রাজ্যের পুরসভাগুলি যে বিভিন্ন দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে, তা টের পাওয়ার অনেক রকম রাস্তা ছিল। বিশেষত, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান চাইলে সে খবর পাবেন না, তেমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী সে দুর্নীতির খবর পেলেন লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনার পরে। পুর অঞ্চলগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে যে ভাঙন ধরেছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রী উদ্বিগ্ন। অতএব, তিনি সেই পুরসভাগুলির প্রধান বা অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত নেতাদের কঠোর তিরস্কার করেছেন। গণতন্ত্রে শেষ অবধি সবই ভোটের দিকে তাকিয়েই ঘটে থাকে— ফলে, ভোটব্যাঙ্কে চিড় ধরায় যদি মুখ্যমন্ত্রী শেষ অবধি পুর-দুর্নীতি বন্ধ করতে উদ্যোগী হন, তা-ই বা মন্দ কী? তবে কিনা, গোটাকয়েক আশঙ্কা থেকে যায়। প্রথমত, ধরে নেওয়া যায় যে, শত দুর্নীতি সত্ত্বেও যদি ভোটে তার প্রভাব না পড়ত, মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত এই দুর্নীতি নিয়ে বিচলিত হতেন না। ধরে নেওয়ার কারণ এই যে, যত দিন না ভোটব্যাঙ্কে কাঁপুনি ধরেছে, তত দিন তিনি এ সব দুর্নীতির দিকে ফিরে তাকাননি। যে সদিচ্ছা শুধুমাত্র নির্বাচনী ফলাফলের উপরে নির্ভর করে, তার প্রতি খুব বেশি ভরসা রাখা মুশকিল। এই মুহূর্তে তাঁর তিরস্কারের তীব্রতায় একটি কথা স্পষ্ট— এমন দুর্নীতির থেকে তিনি নিজের দূরত্ব স্পষ্ট করে দিতে চাইছেন। ইতিপূর্বেও একাধিক ক্ষেত্রে তিনি একই অবস্থান গ্রহণ করেছেন। মুশকিল হল, তিনি এমন একটি দলের সর্বাধিনায়িকা, যেখানে এখনও অবধি তিনিই সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়। সে দলের অন্যায়ের দায় ঝেড়ে ফেলা তাঁর পক্ষে দুষ্কর। সুতরাং, দায় তাঁর থেকেই গেল।
দ্বিতীয় আশঙ্কা হল, মুখ্যমন্ত্রী যত তিরস্কারই করুন, যতই কঠিন অবস্থান নিন, দুর্নীতির ছবিটি পাল্টাবে না। এমনকি, এখন যে নেতারা এই পুরসভাগুলিতে ক্ষমতাসীন, তাঁদের সরিয়ে নতুন কোনও নেতাকে সে পদে আনলেও পরিস্থিতি অপরিবর্তিতই থাকবে। তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি আর ব্যক্তিবিশেষের চারিত্রিক কারণে ঘটে না; তা এখন ব্যবস্থাগত, কাঠামোগত। গ্রাম হোক বা শহর, এ রাজ্য চলে মনসবদারি মডেলে। কোনও নেতার আধিপত্য একটি গ্রামে সীমাবদ্ধ, কেউ আবার একটি গোটা শহরের অধিপতি— কিন্তু, যাঁর রাজনৈতিক অধিকারে যতটুকু জায়গা, সেখানকার খাজনা আদায় করার নির্বিকল্প অধিকারটি তাঁর। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় যে, কোথাও কেউ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খাজনা আদায় করেন, কোথাও কেউ সরকারি চাকরি বিক্রির চক্র গড়ে তোলেন। কেউ অবৈধ বালির ব্যবসার অধিপতি, কারও কাছে আবার কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে বেআইনি নির্মাণের ছাড়পত্র পাওয়া যায়। কর্মসংস্থান যোজনার টাকা থেকে শুরু করে ফুটপাতের দখল, সবই চলে এই মনসবদারি মডেলের মাধ্যমে। এক নেতার থেকে অন্য নেতার হাতে ক্ষমতা যেতে পারে, কিন্তু মডেলের চরিত্রটি পাল্টাবে কি?
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, একই মনসবদারি ব্যবস্থা যদি গোটা রাজ্যে চলে, তা হলে মূলত শহরাঞ্চলেই তৃণমূলের ভোটে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ল কেন? সম্ভবত তার বৃহত্তম কারণ হল, গ্রামের তুলনায় শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাপনের জন্য সরকারি প্রকল্পের উপরে নির্ভরতা তুলনায় কম— শাসক দলের সঙ্গে শহরাঞ্চলের সম্পর্ক মূলত পরিকাঠামোগত এবং প্রশাসনিক। এই দু’টি ক্ষেত্রেই মনসবদারি ব্যবস্থা বিপুল নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অবৈধ নির্মাণ থেকে ক্রমেই অবনতি ঘটতে থাকা পথঘাট, বেদখল ফুটপাত, এবং কার্যত প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা ও পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ মানুষকে শাসক দলের প্রতি বিমুখ করে তুলেছে। অনেক দিন ধরে এই অন্যায়ের নির্মাণ ঘটেছে, অনেক দিন লাগবে এর নিরাময়ে। সেখানে পৌঁছতে হলে রাজ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টে ফেলা প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা কি তত দূর পৌঁছতে পারবে?