বিন্দেশ্বর পাঠক। —ফাইল চিত্র।
বিন্দেশ্বর পাঠকের জীবনাবসান ঘটল স্বাধীনতা দিবসে। ‘সুলভ শৌচালয়’ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বিন্দেশ্বর ভারতকে সুষ্ঠ, সুস্থায়ী এবং সম্মানজনক শৌচ ব্যবস্থার পথ দেখিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে কাজ করেছিলেন সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। নিম্নবর্ণের যে মানুষদের বর্জ্যবাহীর ভূমিকা নিতে বাধ্য করত সমাজ, তাদের সে কাজ থেকে মুক্ত করে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ধারণের পথও তিনি দেখিয়েছিলেন। আক্ষেপ, এ দুটো কাজ— যা সভ্য সমাজের ন্যূনতম শর্ত— ভারতে আজও অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালে ভারতকে উন্মুক্ত শৌচ থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করলেও, পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) দেখিয়েছে যে, ভারতে অন্তত কুড়ি শতাংশ গৃহের সদস্যরা এখনও উন্মুক্ত শৌচে অভ্যস্ত, এবং গ্রামীণ ভারতে চব্বিশ শতাংশ গৃহস্থালিতে এখনও শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। শহরের পরিসংখ্যান তুলনায় ভাল, কিন্তু নগরবাসী মাত্রেই জানেন, মহানগরের রূপ সকলের জন্য এক নয়। বস্তিগুলিতে এখনও দেখা যায়, তিরিশ-চল্লিশটি পরিবারের জন্য একটিমাত্র শৌচাগার রয়েছে। তদুপরি, শহরের রাস্তা মাত্রেই উন্মুক্ত শৌচাগার হিসাবে ব্যবহৃত হয়, সে দৃশ্যও সর্ব ক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভারত সরকার সংস্কার এনেছে আইনে— মানববর্জ্য বহনে কোনও মানুষকে নিয়োগ করা চলবে না (১৯৯৩), মানুষকে নিয়ে সেপটিক ট্যাঙ্ক বা নিকাশি নালা পরিষ্কার করার কাজও করানো যাবে না (২০১৩)। তা সত্ত্বেও ভারতে এই সব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ অব্যাহত। ২০২১ সালে সংসদে পেশ করা তথ্য অনুসারে, ভারতে ২০১৬-২১ সালের মধ্যে শৌচ ও নিকাশি নালা পরিষ্কার করতে গিয়ে ৩২১ জন নিহত হয়েছেন। অসরকারি সংস্থাগুলির দাবি, সংখ্যাটি আরও বেশি।
মানববর্জ্যবাহী দলিত পরিবারগুলি কী অমানবিক পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকে, তা সমাজতত্ত্বের গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছিলেন বিন্দেশ্বর পাঠক। একটি ঘটনা তাঁকে বিশেষ ভাবে আন্দোলিত করেছিল— এক বালক ষাঁড়ের আক্রমণের সামনে পড়লে অনেকে তাকে বাঁচাতে ছুটে আসে। কিন্তু ছেলেটি বর্জ্যবাহী দলিত জাতির, সে কথা কেউ বলামাত্র সকলে পিছিয়ে যায়, বালকটিকে ‘নির্বিঘ্নে’ হত্যা করে ষাঁড়। গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত তরুণ বিন্দেশ্বর স্বাস্থ্যকর শৌচাগার নির্মাণ, এবং দলিতদের অন্য কাজে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন সত্তরের দশকে। বহু চেষ্টার পর তাঁর উদ্ভাবিত শৌচাগারের মডেলকে গ্রহণ করে বিহার সরকার। ক্রমে তা ছড়ায় সারা দেশে। এই নির্মাণে বর্জ্যকে বায়োগ্যাস এবং জৈব সার-সমৃদ্ধ সেচের জলে পরিণত করার উপায়ও রয়েছে।
ভারতীয়দের স্বভাব হল আদর্শবাদী, কৃতবিদ্য ব্যক্তিকে বহু সম্মান দানের ঘটা করে, কাজের বেলা তাঁর আদর্শটিকে উপেক্ষা করা। বিন্দেশ্বর পাঠকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভারতীয় রেল আজও মানব বর্জ্যবাহকদের বৃহত্তম নিয়োগকর্তা। বিভিন্ন পুরসভাও নিয়মিত তাদের নিয়োগ করে। উন্মুক্ত শৌচ কেন দূর হচ্ছে না, সেই আলোচনাতেও ভাটা পড়ছে সরকারি অনাগ্রহে। কেন্দ্রীয় সরকার স্বচ্ছ ভারত অভিযানে গান্ধীজির চশমাটিকে নিয়েছে, তাঁর আদর্শের অন্তর্নিহিত দর্শনটিকে গ্রহণ করতে পারেনি। নয়তো সরকার মনে রাখত যে, যত দিন এক জনও নিম্নবর্ণের মানুষ মানববর্জ্য বইবেন, তত দিন ভারত স্বাধীন দেশ নয়।