শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে শিশুর মানসিক বা আচরণগত সমস্যার জন্য তাকে বর্জন বেআইনি। প্রতীকী ছবি।
পাঁচ বছরের শিশুকে দুরন্তপনার জন্য ‘সাসপেন্ড’ করল কলকাতার একটি প্রাথমিক স্কুল। এমন ঘটনায় স্কুলের শিক্ষাদানের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি হয়ে পড়ে। দুষ্টুমি শৈশবের ধর্ম, কিছু শিশু যে অন্যদের চাইতে বেশি চঞ্চল এবং অবাধ্য হবে, এ-ও প্রকৃতিরই নিয়ম। শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব যাঁরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছেন, তাঁরা এমন অতি-দুরন্ত শিশুদের শিক্ষার দায়ও স্বীকার করেছেন। ‘অসুবিধেজনক’ শিশুদের স্কুলের পরিসর থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার অর্থ, তাঁরা শিক্ষকতার শর্ত লঙ্ঘন করছেন। শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে শিশুর মানসিক বা আচরণগত সমস্যার জন্য তাকে বর্জন বেআইনি, অতএব অপরাধও বটে। আক্ষেপ, এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যে শিশুরা বিশেষ মনোযোগ দাবি করে, তাদের প্রতি ভারতের স্কুলগুলি এমনই নিষ্ঠুর। বিশেষ শিশুদের প্রতি নিজেদের এই অপরাধ ঢাকতে স্কুল কর্তৃপক্ষ কেবলই অভিভাবক ও পড়ুয়াদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগাতে চায়। অন্য পড়ুয়াদের অসুবিধা হচ্ছে, পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে, এমন নানা অজুহাতে চাপ সৃষ্টি করে অভিভাবকদের উপরে, যাতে সন্তানকে সরিয়ে নিতে তাঁরা বাধ্য হন। অথচ, দুরন্ত শিশুকে সুশৃঙ্খল করে তোলার কৌশল শিক্ষকদেরই জানার কথা, এবং বহু শিক্ষক এ কাজ সাফল্যের সঙ্গে করছেন।
দলছুট পড়ুয়ার কাউন্সেলিং, অভিভাবকদের মানসিক সহায়তা, বাড়িতে শিশুকে পড়ানোর প্রশিক্ষণ দান, প্রয়োজনে ‘স্পেশাল এডুকেটর’-এর সাহায্য নিয়ে স্কুলে বিশেষ শিশুর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, এ সব স্কুলেরই কর্তব্য। হরিনাভির স্কুলটি যে পাঁচ বছরের শিশুর আচরণগত সমস্যা সংশোধনের দায় সম্পূর্ণ অভিভাবকের উপরে চাপিয়েছে, তা শিক্ষকের ভূমিকা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের খণ্ডিত দৃষ্টি প্রকাশ করে। শিক্ষার অধিকার আইন বিশেষ শিশুদের সাধারণ স্কুলে পড়ার অধিকার দিয়েছে, সে বিষয়ে সরকারি নিয়মবিধিও জারি হয়েছে। স্কুলগুলি তা অবাধে লঙ্ঘন করে। শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা, শেখার সমস্যা, অথবা আচরণগত সমস্যা রয়েছে যে শিশুদের, হয় তাদের স্কুলে প্রবেশই রুখে দেয় কর্তৃপক্ষ, অথবা তারা বিতাড়িত হয়, না-হলে তাদের সম্পূর্ণ অবহেলা করা হয়। আত্মগ্লানি ও হীনতার বোধ নিয়ে স্কুলের পাঠ শেষ করে এই দুর্ভাগা শিশুরা। অথচ, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সাহচর্য পেলে বিশেষ শিশুরা মনের বা আচরণের সমস্যাকে অনেকখানি অতিক্রম করতে পারে।
শিক্ষা দফতরের ভূমিকাও তথৈবচ— ‘স্পেশাল এডুকেটর’ পদে নিয়োগ প্রায় বন্ধ। নামী-দামি বেসরকারি স্কুল থেকে পাড়ার সরকারি স্কুল, সর্বত্র বিশেষ শিশুদের ‘বিশেষ স্কুল’-এ পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয় অভিভাবকদের। এই সঙ্কট ‘শিক্ষা’ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে। শিক্ষকরা অনবরত ‘পরীক্ষা’ নামক ফিতে দিয়ে মেপে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবেন— এরই নাম শিক্ষাব্যবস্থা। অন্যের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়াকে ‘সময় নষ্ট’ বলে মনে করার শিক্ষা দিচ্ছে স্কুল। এতে না মেলে ভাল কর্মী, না তৈরি হয় ভাল মানুষ। যে প্রতিষ্ঠান শিশুর বিপন্নতার চাইতে শিক্ষকের স্বস্তি-সুবিধাকে অধিক গুরুত্ব দেয়, তার শিক্ষাদানের অধিকার নেই। সব শিশুকে এক ছাঁচে ঢালাই করার কারখানা ‘স্কুল’ পদবাচ্য নয়।