কেন্দ্র ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দুই সরকার পৃথক হওয়ার কারণেই বিজেপি ও আম আদমি পার্টির মধ্যে এত কাজিয়া। ফাইল ছবি।
রাজনীতি বড় বালাই, ক্ষমতার রাশ যেন কদাপি আলগা না হয়, চলে না যায় অন্য দল তথা সরকারের হাতে, তা নিশ্চিত করতে চলে দড়ি টানাটানির খেলা। যেমন চলছে কেন্দ্রীয় সরকার ও অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সরকারের মধ্যে। দিল্লি এক দিকে রাজধানী, অন্য দিকে একটি রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত একটি দল সরকার গড়েছে। কেন্দ্র ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দুই সরকার পৃথক হওয়ার কারণেই বিজেপি ও আম আদমি পার্টির মধ্যে এত কাজিয়া। শাসনতন্ত্রে আসল কাজের কাজি আমলারা, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের রাশ হাতে থাকা মানে প্রশাসনিক লাগাম হাতে থাকা। এ প্রসঙ্গেই সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি জানিয়ে দিল, দিল্লি সরকারে কর্মরত আমলাদের বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিল্লি সরকারের, কেন্দ্রের নয়। আমলারা কাজ করেন নির্বাচিত সরকারের অধীনে, তাঁরা সেই সরকারের প্রতিই দায়বদ্ধ। তাই বিভিন্ন দফতরের আমলাদের নিয়োগ বা বদলি-সহ যাবতীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ক্ষমতার অধিকারী আপ সরকারই, কেন্দ্র নয়। কেন্দ্র শুধু আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ ও ভূমি দফতর সংক্রান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেবে, যে ভার আগে থেকে তাদের উপর ন্যস্ত।
সন্দেহ নেই যে জায়গাটি দিল্লি বলেই, কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনক্ষমতার ভরকেন্দ্র বলেই তার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিজেপি ও আপ সরকারের এই দ্বৈরথ। এই টানাপড়েন আজকের নয়, চলছে প্রায় আট বছর ধরে, এবং মাঝেমাঝেই তার মোকাবিলায় শীর্ষ আদালতের দরকার পড়েছে। ২০১৮ সালেও সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল কেন্দ্র ও দিল্লি সরকারের উচিত নিজেদের মতভেদ দূরে সরিয়ে রাখা, পরিণত নেতৃত্বের উদাহরণ স্থাপন করা। এই সূত্রেই সুপ্রিম কোর্ট ব্যবহার করেছিল ‘কোলাবোরেটিভ ফেডারালিজ়ম’-এর মতো শব্দবন্ধ, পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটিকে দৃঢ় করার বার্তা। তাতে যে লাভ হয়নি, প্রমাণ শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক নির্দেশ: কেন্দ্রের কতটুকু এক্তিয়ার, কোথায় তার লক্ষ্মণরেখা, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া। দিল্লির নির্বাচিত সরকার অন্য দলের বলেই কেন্দ্রের এত মাথাব্যথা— কখনও উপরাজ্যপাল মারফত, কখনও সরাসরি কেজরীওয়াল সরকারের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার খবরদারি। অথচ খাস রাজধানীতে দু’টি সরকারের সুস্থ সমান্তরাল উপস্থিতি বিশ্বের কাছে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সৌন্দর্য ও গুরুত্বের উদাহরণ হয়ে উঠতে পারত।
এই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গণতন্ত্রের নজির স্থাপনার প্রত্যাশা নিছক বাড়াবাড়ি। যে যে রাজ্যে অ-বিজেপি সরকার ক্ষমতায়, তাদের সঙ্গে কেন্দ্রের ‘সম্পর্ক’ই প্রমাণ করে, সংবিধানে বলা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর শুদ্ধতা-বৈধতা রক্ষা এই সরকারের দূরতম কল্পনাতেও নেই, কাজে দূরস্থান। সে জন্যই কোথাও উপরাজ্যপাল বা রাজ্যপালকে দিয়ে কেন্দ্র চোখ রাঙায়, আর্থিক ও পরিকাঠামোগত অসহযোগিতায় ‘অপ্রিয়’ রাজ্যগুলিকে হয়রান করে। এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে ভূলুণ্ঠিত হয় শাসনতন্ত্রের প্রাণভ্রমরা সংবিধানই। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র ভরসা বিচারব্যবস্থাই। দিল্লির ঘটনায় কেন্দ্র হয়তো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সাংবিধানিক বেঞ্চে যাবে। এক দল এক সরকারের স্বপ্ন দেখা কেন্দ্রের কাছে সেটাই প্রত্যাশিত, যুক্ততার সাধনা নয়।