সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল ছবি।
ধর্মপরিচিতি যেমনই হোক না কেন, ঘৃণাভাষীর বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর দায়ের করতে হবে সরকারকে— এমনই নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। সব ক’টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতি সর্বোচ্চ আদালতের এই নির্দেশ ফের স্পষ্ট করে দিল, ঘৃণাভাষণকে কতখানি জঘন্য অপরাধ বলে দেখছে সুপ্রিম কোর্ট। সাধারণত কোনও অপরাধ ঘটলে যে ব্যক্তি (বা গোষ্ঠী) অপরাধের শিকার, তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে থাকেন। পুলিশ বা প্রশাসনের তরফে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা বিরল না হলেও, ব্যতিক্রমী বলেই বিবেচিত হয়। ঘৃণাভাষণের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যতিক্রমকেই নিয়ম বলে ঘোষণা করল শীর্ষ আদালত। বিচারপতি কে এম জোসেফ এবং বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন বলেছেন, ভারতের সংবিধানে বিধৃত ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেই জন্য ঘৃণাভাষী কোন ধর্মগোষ্ঠীর, তা না দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা দরকার। আইনের কোন ধারাগুলির প্রয়োগ করা যায় ঘৃণাভাষীর বিরুদ্ধে, তা-ও বলে দিয়েছেন বিচারপতিরা। প্রকাশ্যে ঘৃণাভাষণের ঘটনা দেখেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় রয়েছে, এমন ঘটনা নজরে এলে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে রাজ্যগুলিকে: সতর্ক করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি জোসেফের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ঘৃণাভাষণ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হৃদয়ের বিরুদ্ধে, এবং দেশবাসীর মর্যাদার বিরুদ্ধে যায়, তা বস্তুত দেশের চরিত্রকে নষ্ট করে। ইতিপূর্বে বিচারাধীন এই মামলাটিরই একটি শুনানিতে দুই বিচারপতির এই বেঞ্চ মন্তব্য করেছিল যে, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলার প্রবণতা না থামালে, রাজনৈতিক লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহারের চেষ্টা বন্ধ না হলে, জনমাধ্যমে বা প্রকাশ্য সভায় অন্য গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ-বর্ষণ, তাদের ‘অপরাধী’ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা বন্ধ হবে না।
অত্যন্ত জরুরি এই নির্দেশ। আক্ষেপ এই যে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও দেশের শীর্ষ আদালতকে এই ভাবে বার বার মনে করাতে হচ্ছে, ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি রক্ষা করা নির্বাচিত সরকারের কর্তব্য, এবং সংবিধানের অন্যতম প্রধান বার্তাটি ধর্মনিরপেক্ষতার। গত অক্টোবরেও দিল্লি এবং হরিদ্বারে কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের ঘৃণাভাষণের মামলায় বিচারপতি জোসেফ এবং বিচারপতি হৃষীকেশ রায় দিল্লি, উত্তরাখণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশের সরকারকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। তারও আগে, ২০১৮ সালে, গণপিটুনি এবং অন্যান্য গণহিংসার ঘটনাকে নিবৃত্ত করার রূপরেখা (গাইডলাইন) দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। তা সত্ত্বেও ঘৃণাভাষীদের গরল-বর্ষণ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কতখানি বিপন্ন করছে, সাম্প্রতিক অতীতে তার দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
অভাব যদি কিছু থাকে, তবে তা ঘৃণাভাষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। সেই দায়িত্ব সর্বার্থে শাসনবিভাগের। জনসমক্ষে বিদ্বেষের উদ্গারকে নিবৃত্ত না করে প্রকাশ্যে বা গোপনে প্রশ্রয় দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল, এ অভিযোগ বার বার উঠেছে। শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন মামলাটিতে আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী জানিয়েছেন, মহারাষ্ট্রে ঘৃণার উদ্গার চলছে যে সব সভায়, সেখানে সাংসদ, বিধায়করাও উপস্থিত থাকছেন। তবু মহারাষ্ট্র সরকার কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করেনি। এই নিষ্ক্রিয়তাই বদলে যায় অতি-সক্রিয়তায়, যখন সাংবাদিক, লেখক-শিল্পী, বা অন্যান্য নাগরিক ক্ষমতাসীন দলের কাজ বা বক্তব্যের সমালোচনা করেন। তখন তাঁদের উপর ক্রমাগত আরোপিত হতে থাকে ঘৃণাভাষণ, উত্তেজনা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত, প্রভৃতি অপরাধের কঠোর ধারা। অর্থাৎ, ঘৃণাভাষণ নিবৃত্ত করার ধারাগুলি এখন বাক্স্বাধীনতা রুদ্ধ করার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংবিধানে গণতান্ত্রিক, সাম্যময়, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের যে আদর্শ বিধৃত রয়েছে, সব দিক দিয়েই এখন সেগুলি শেলবিদ্ধ হয়ে চলেছে।