—ফাইল চিত্র।
একচল্লিশ জন শ্রমিক আটকে আছেন মাটির অনেক নীচে সুড়ঙ্গে, দুই সপ্তাহ পূর্ণ হল। অন্ধকার ভূগর্ভে তাঁরা অপেক্ষা করছেন, ভাবছেন, ‘অচিরেই’ তাঁদের উদ্ধার করবে তাঁদের সরকার। তাঁরা জানেন না, পনেরো দিন পর এখনও উদ্ধারকারীদের কাছে অধরা রয়ে গেছে তাঁদের কাছে পৌঁছনোর উপায়। একের পর এক প্রয়াস ব্যর্থ, কবে কত দিন পর সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা তার হদিসটুকুও নেই। তাঁদের কাছে যখন বা যে দিন পৌঁছনো সম্ভব হবে, তাঁরা জীবিত থাকবেন কি না, থাকলেও সুস্থ থাকবেন কি না— জানা নেই। ভূপৃষ্ঠে বসে আকুল অপেক্ষায় ধৈর্যের অনন্তসমান পরীক্ষা দিচ্ছেন শ্রমিকদের পরিবার-পরিজন। আশা রাখছেন, কোনও না কোনও ভাবে ফেরত পাবেন তাঁদের মানুষটিকে। পাহাড় কেটে কেটে সেই ভূগর্ভ-ফাঁদের কাছে পৌঁছনোর কাজটি নিশ্চয় সহজ নয়। কিন্তু আরও অনেক কিছুর মতো এ কাজ সহজ হওয়ার কথাও ছিল না। প্রয়োজন পড়লে, অঘটন ঘটলে— ‘কঠিন’ কাজটি কী ভাবে সাধন করা যায়, তা জানার কথা তাঁদেরই, যাঁরা সাধারণ দরিদ্র শ্রমিকদের এই অসম্ভব দুরূহ কাজে পাঠিয়েছেন। কৃষ্ণগহ্বর শব্দটি অতিব্যবহারে জীর্ণ, কিন্তু রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে এত দিন ধরে তেমন গহ্বরের মধ্যে অনিশ্চিত শ্বাসগ্রহণ কত ভয়ানক হতে পারে! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী নানা রকম প্রবোধ ও আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করছেন ঠিকই, তবে উদ্ধারকাজে এই দুই সপ্তাহব্যাপী অসফলতাকে যে-সে বিষয় বলা চলে না, এ এক ভয়ঙ্কর অমানবিক দায়স্খলন: অক্ষমণীয়। অতঃপর নানা রকম তত্ত্ব ও তথ্যজালে এই ব্যর্থতার বিশ্লেষণের চেষ্টা চলবে। কিন্তু তা শুরু হওয়ার আগেই সোজা কথাটি সোজা করে বলা ভাল— চন্দ্রবিজয়ী, বিশ্বগুরু-প্রতিম ভারতবর্ষ ও তার সরকার বিপন্ন নাগরিকের প্রাণ রক্ষা করতে অতি করুণ ভাবে অক্ষম। শেষাবধি যদি শ্রমিকদের বার করা যায়ও, তা সত্ত্বেও যে অপরিসীম দুর্বলতা ও অদক্ষতা প্রকট হল এই কয়েক দিনে, তা মার্জনার অতীত।
দায়স্খলন ঘটেছে, ঘটছে একাধিক স্তরে। উত্তরাখণ্ডের পার্বত্য এলাকায় সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গ-ধসের পরিপ্রেক্ষিতে এখন স্পষ্ট হচ্ছে বহু তথ্য। যে ভাবে লম্বালম্বি ভাবে পাহাড় কাটা হয়ে থাকে এই অঞ্চলে, তাতে নাকি ধসের সম্ভাবনা যে কোনও মুহূর্তে। অথচ উপযুক্ত নিরাপত্তা না নিয়েই কাজ চলতে থাকে। ‘সেফ প্যাসেজ’ তৈরির কথা ভাবাই হয় না কাজ চলার সময়ে। বর্তমান সঙ্কটের খবর আসায় এখন হিমাচলপ্রদেশের শিমলা ও সোলান অঞ্চলে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের কাজ কী ভাবে হচ্ছে জানতে ছুটেছেন সেখানকার কতিপয় নেতা। বিভিন্ন টানেলের মধ্যে সংযোগসাধন করে যাতে জরুরি প্রয়োজনে শ্রমিকদের বার করে নেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা ভাবা হচ্ছে। একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে এসেও এ দেশের নির্মাণ-কর্তাদের এই আগাম নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরির কথা আগে মনে হয়নি— আজ উত্তরাখণ্ডের একচল্লিশ জন শ্রমিক নিজেদের জীবন বাজি রেখে এই কথাটি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। অবশ্য তা সত্ত্বেও ‘বোঝা’ ঠিকমতো হল কি না, তার সাক্ষ্য দেবে ভবিষ্যৎ।
একই সঙ্গে, সরকার পক্ষের উল্টো দিকে যাঁরা আছেন, তাঁদের কথাও বলতে হয়। কর্মী-নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার এই তীব্র অভাব, সমাজ-অর্থনীতির বাস্তব সমস্যাগুলির দিকে এই হিমালয়সমান অবজ্ঞা এ দেশে ক্রমশই যেন অবহনীয় পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি কেন এত দিন এই নিরাপত্তা নিয়ে সরব হয়নি, কেন রাজনৈতিক দলের শ্রমিক নেতারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি, এ সব প্রশ্ন ওঠা দরকার। প্রশ্ন ওঠা দরকার, কেন মন্দির নির্মাণে যে মনোযোগ, সুড়ঙ্গ নির্মাণে তার কিয়দংশও দেখা যায় না। তবে কিনা, যে সমাজ গোরক্ষার দাবিতে, কিংবা সংখ্যালঘু দমনে সরব হতে এতটুকু সময় ব্যয় করে না, সেই সমাজ কী ভাবে এমন ঘটনায় অসীম নির্বিকারত্বের পরিচয় দেয়, সে প্রশ্ন ওঠানো বাতুলতা। উত্তর মিলবে না।