অঘটনের সম্ভাবনা যথেষ্ট। জুনের মাঝামাঝি থেকে সেই ইঙ্গিতও মিলছে প্রতিনিয়ত করোনা-আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির পরিসংখ্যানে। তা সত্ত্বেও চোখ বুজে থাকার যে অভ্যাসটি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং এক শ্রেণির জনতা রপ্ত করেছে, তা দেখে চমৎকৃত হতে হয়। ভিড় নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক দূরত্ববিধি পালন দূরে থাক, এখনও অবধি মাস্ক পরা-সহ ন্যূনতম কোভিডবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে কোনও তৎপরতা দেখা গেল না। আপাতত সংক্রমণের যা চরিত্র তাতে জানা গিয়েছে, গুরুতর অসুস্থের সংখ্যা মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছয়নি। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই। এটি সত্যই কোনও নতুন স্ট্রেন কি না, বা এর ক্ষতি করার ক্ষমতা কতটা, সে সব নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর সময় এখনও আসেনি। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির গোড়ার দিকে গুরুতর অসুস্থতা অথবা মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকতেই পারে। কিন্তু পরবর্তী কালে তাতে যে কোনও বিশাল লাফ দেখা দেবে না, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। অভিজ্ঞতা বলে, পরিস্থিতি যেমনই হোক, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই সাবধান হওয়া জরুরি। অথচ, রাজ্য সরকার এবং এক বিশাল সংখ্যক নাগরিকের গয়ংগচ্ছ মনোভাব দেখে বোধ হয় না, কেউই অভিজ্ঞতা থেকে কোনও রকম শিক্ষা নিয়েছে বলে।
বস্তুত এই মর্মান্তিক উদাসীনতা গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও দেখা গিয়েছিল। পরিণতিতে, পরের দু’-তিন মাসে গোটা দেশ-সহ পশ্চিমবঙ্গকেও যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। তার পরেও চিকিৎসকদের সতর্কবাণীকে এমন অগ্রাহ্য করা কেন? কোন সর্বনাশের প্রতীক্ষায়? এই পর্বে যে বিষয়টি ভাবাচ্ছে তা হল, শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা। ১২ বছরের কম বয়সিরা এখনও টিকার একটি ডোজ়ও পায়নি। সুতরাং, তারাই এই মুহূর্তে সর্বাধিক বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে। নিঃসন্দেহে এখনও অবধি শিশুদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার সংখ্যাটি নগণ্য, কিন্তু তাদের মাধ্যমে বয়স্ক ও অন্য নানা রোগাক্রান্তদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমতাবস্থায় বড়রা সতর্ক না হলে অচিরেই তারা এবং তাদের মাধ্যমে অন্যরাও বিপন্ন হবে।
প্রশ্ন হল, টনক নড়বে কবে? জনগণ যথেচ্ছ কোভিডবিধি ভাঙছে, নির্জলা সত্য। কিন্তু সেই বিধি ভাঙায় এত দিন যে অবাধ প্রশ্রয় সরকার জুগিয়ে এসেছে, তার মূল্য ক’টি প্রাণের বিনিময়ে চোকাতে হবে, জানা নেই। এই পর্বে অন্তত করোনা প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় দিয়েছে। কিন্তু সেই সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করে দ্রুত বুস্টার ডোজ় দানের কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং কোভিডবিধি পালন বাধ্যতামূলক করার পরিশ্রমটুকুও কেন করা হল না? জনস্বাস্থ্য রক্ষা সরকারের দায়িত্ব, ঠিক যেমন শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠু ভাবে, স্বাভাবিক নিয়মে যাতে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করাও সরকারেরই কাজ। সর্বোপরি, জনগণ যদি সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে নিমজ্জিত থেকে গোষ্ঠীস্বার্থের কথাটি বিস্মৃত হয়, তবে তাকে ঠিক সময়ে কথাটি মনে করিয়ে দেওয়ার দায়ও সরকারেরই। কোনও অজুহাতেই এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। স্বাস্থ্যসুরক্ষার ক্ষেত্রে যদি শেষপর্যন্ত ভাইরাসের বদান্যতার উপরে নির্ভর করে থাকতে হয়, তবে তা নিতান্তই দুর্ভাগ্যের।