হেনস্থার মাত্রা ঠিক কোন সীমারেখা পার করলে তাকে সরাসরি ‘র্যাগিং’ বলে চিহ্নিত করা যায়, তার স্পষ্ট উত্তর পাওয়া কঠিন হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়। তেমনই, কোনও বিশ্ববিদ্যালয় কোন দুঃসহ স্পর্ধায় ছাত্র-হেনস্থার ঘটনায় বার বার সংবাদ শিরোনামে উঠে আসতে পারে, সে কথা আপাত ভাবে অস্পষ্ট হলেও রাজ্যের পরিস্থিতি বিষয়ে অবগত নাগরিকের তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। আসল কথা, দু’টি ক্ষেত্রেই, সত্যে পৌঁছনোর জন্য দরকার কেবল— অন্যায় দূর করার দৃঢ় সঙ্কল্প। এবং যেখানে অল্পবয়সি ছেলেমেয়ের মন ও প্রাণ নিয়ে টানাটানি, সেখানে সেই অন্যায় দূরীকরণ সঙ্কল্পের অনেক গুণ দৃঢ়তর হওয়ার কথা। অথচ দেখা যাচ্ছে, গত বছরের অগস্টে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে ‘র্যাগিং’-এর জেরে তিন তলার বারান্দা থেকে পড়ে এক নবাগতের প্রাণ হারানোর মর্মান্তিক ঘটনার এখনও বছর পেরোয়নি— ফের ছাত্র-হেনস্থার ঘটনায় নাম জড়াল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই হেনস্থার মাত্রা এমনই যে, পুরুলিয়া থেকে আগত স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্রটিকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ভর্তি করাতে হল হাসপাতালে। দুই বছরে দু’টি ঘটনার মধ্যে তফাত এইটুকুই যে, এ যাত্রায় প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু যে ভাবে অতি তৎপর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্তের পূর্বেই ঘটনাটিকে ‘র্যাগিং নয়’-এর তকমা দিয়ে দিলেন— তাতে একটি সত্য সন্দেহাতীত। না, অন্যায় দূর করার দৃঢ় সঙ্কল্পটি তাঁদের নেই।
সঙ্কল্প তো নেই-ই, বরং ‘র্যাগিং নয়’ কথাটির মধ্যে একটি অসহনীয় স্পর্ধা ও অন্যায়ের প্রশ্রয় আছে। প্রথমত, কোনটা ‘র্যাগিং’ কোনটা নয়, এই সূক্ষ্ম বিচার যদি করতেই হয়, তার প্রথম সূত্রই হল— শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতনই ‘নির্যাতন’ নয়। মারধর হয়নি মানেই যে নির্যাতনকারীদের অপরাধ গুরুতর নয়, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, মানসিক নির্যাতন কত ভয়ানক হতে পারে, তাও কি আজকের দিনে আলাদা করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে? সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যে নানা প্রসঙ্গে মানসিক নির্যাতনের গুরুত্ব নিয়ে একাধিক রায় দিয়েছে। তৃতীয়ত, কার কাছে কোনটা ‘যথেষ্ট’ নির্যাতন, তার বিচার কি একমাত্রিক হতে পারে? পরিস্থিতির বিচার কি এ সব ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি নয়? কোনও কিশোর প্রথম বার বাড়ির বাইরে থাকতে এসে কোন ব্যবহারে আক্রান্ত ও বিপন্ন বোধ করতে পারে, তার কি কোনও সরল নির্দেশিকা আছে কর্তৃপক্ষের কাছে? চতুর্থ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল— কেন সদ্য-আগত কিশোরদের নির্যাতন করার কথা আদৌ ভাববে তাদের সিনিয়ররা? কেন এই অমানবিক প্রবণতাকে পোষণ করে চলবে কর্তৃপক্ষ? যারা তা করবে, তাদের কেন শাস্তি দেওয়া হবে না?
র্যাগিং কোনও নতুন বিষয় নয়, তার বিরুদ্ধে বিধিও এত দিনে মজুত। তাই এক গোত্রের শিক্ষার্থীর আচরণ যদি কারও কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, এবং তখন প্রয়োজনীয় সাহায্য যদি অন্যদের কাছ থেকে না মেলে, তা হলে সেই ঘটনার বিচার চাই, নতুবা তা বিচারকদেরই অপরাধ। কেবল বিচার নয়, শাস্তিও চাই। যে ভাবে ল্যাপটপ চুরির অভিযোগে ছাত্রটিকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছিল, তা কি নির্যাতন নয়? অসুস্থ হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যে ভাবে বাধা দিয়েছিল কিছু ছাত্র, তা কি নির্যাতন নয়? সমগ্র ঘটনায় হস্টেল কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীনতার ছাপটি স্পষ্ট। কোন সাহসে ছাত্ররা অসুস্থ নবাগতকে চিকিৎসার প্রয়োজনে বাইরে নিয়ে যেতে গেলে মেডিক্যাল অফিসারের কাছে লিখিত বিবৃতি দাবি করে? চুরির অভিযোগ যদি সত্যও হয়, তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ না জানিয়ে নিজেরাই বিচারসভা বসাতে পারে কার অলিখিত প্রশ্রয়ে? কেন গত বছরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় এত দিন পরে শো-কজ় প্রক্রিয়া শুরু হল? রাজ্যের তথাকথিত ‘সেরা’ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যদি এমন ঘটতে পারে, অন্যত্র তবে কী ঘটছে?