রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠে বিক্ষুব্ধ কৃষকদের সমাবেশ আজ ছয় মাস অতিক্রান্ত হইতেছে। কোভিড অতিমারির মধ্যে, বিশেষত দিল্লিতে তাহার প্রচণ্ড প্রকোপের মধ্যেও অগণিত কৃষক ও তাঁহাদের সমর্থকরা শীত, গ্রীষ্ম এবং সংক্রমণের আশঙ্কা মাথায় লইয়া, আক্ষরিক অর্থে প্রাণ হাতে করিয়া বসিয়া আছেন, কয়েক শত বিক্ষোভকারীর মৃত্যুও তাঁহাদের মনোবল ভাঙিতে পারে নাই, ইহা সমবেত প্রতিস্পর্ধার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসাবে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। ঠিক তাহার বিপরীতে, এবং তাহার সমান অনুপাতে, ইতিহাসের পাতায় গভীর কলঙ্কের অক্ষরে লিখিত থাকিবে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা। কৃষক স্বার্থের পক্ষে হানিকর তিনটি কৃষি বিল সংসদে কার্যত জবরদস্তি করিয়া পাশ করাইয়া শাসকরা যে অন্যায়ের সূচনা করিয়াছিলেন, পরবর্তী আট মাসে তাঁহারা সেই ট্র্যাডিশন সমানে চালাইয়াছেন। আইন তিনটি প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা দিতে হইবে— কৃষকদের এই দাবিতে সরকার কর্ণপাত করিতে প্রস্তুত নহে, এমনকি জানুয়ারির পরে তাহারা বিক্ষোভকারী সংযুক্ত কিসান মোর্চার সহিত আলোচনাও বন্ধ করিয়াছে। এই অচলাবস্থা তাহারই পরিণাম। ইহার দায় নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সরকারের।
সেই দায় স্পষ্ট ভাষায় স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন দেশের বারোটি বিজেপি-বিরোধী দলের নেতা ও নেত্রীরা। গত ১২ মে তাঁহারা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখিয়া কৃষকদের দাবি মানিবার আহ্বান জানাইয়াছিলেন। কোনও লাভ হয় নাই। আন্দোলনের ছয় মাস পূর্তির পূর্বলগ্নে তাঁহারা একটি যৌথ বিবৃতিতে আজ কিসান মোর্চার দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিকে সমর্থন জানাইয়াছেন এবং কেন্দ্রের অনমনীয় মনোভাবের তীব্র নিন্দা করিয়াছেন। কেবলমাত্র বিবৃতিতে কোনও লাভ হইবে না। নিখাদ নিরঙ্কুশ অহমিকা বর্তমান শাসকদের স্বধর্ম। কোভিডের মোকাবিলা হইতে সেন্ট্রাল ভিস্টা, কাশ্মীরের স্বশাসন হইতে কৃষক আন্দোলন— সমস্ত প্রশ্নে তাঁহারা যাহা স্থির করেন তাহাই করিবেন, কাহারও কথা শুনিবেন না। এই অগণতান্ত্রিকতার ব্যাধি মজ্জাগত না হইলে এত দিনে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কৃষকদের সহিত আলোচনায় বসিতেন, প্রয়োজনে একাধিকবার; সরকারি অবস্থানে প্রয়োজনীয় সংশোধন ঘটাইতেন। বিরোধী দলগুলির পরামর্শও চাহিতে পারিতেন তিনি। মুক্ত আলোচনার সেই অনুশীলন হইতে ভারতীয় গণতন্ত্র এক নূতন শক্তি অর্জন করিত। কিন্তু মোদীতন্ত্র অন্য ধাতুতে গড়া।
ভরসা একটিই। এই উদ্ধত স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরোধিতা ক্রমশ বিস্তৃত ও গভীর হইতেছে। বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত প্রতিবাদ তাহার সূচক। এই প্রতিবাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রটিও তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের অধিকাংশ রাজ্যের প্রধান বিজেপি-বিরোধী বা নিরপেক্ষ দলগুলি এই যৌথ বিবৃতিতে শামিল হইয়াছে। ইহা লক্ষণীয় যে, সংবিধানে কৃষি প্রধানত রাজ্যের বিষয় হিসাবে স্বীকৃত। কৃষি সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন যুগ্ম তালিকায় রাখা হইয়াছে, কৃষিপণ্য সরবরাহের বিষয়ে কেন্দ্রকে কিছু বিশেষ ক্ষমতাও দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু সংবিধানের মৌলিক অভিমুখটি এই ক্ষেত্রে রাজ্যের দিকেই নির্দিষ্ট। অথচ নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহেরা সেই অভিমুখের বিপরীতে চলিতে বদ্ধপরিকর। কেবল কৃষি নহে, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো প্রশ্নে, এবং আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করিবার ব্যগ্রতাতেও এই এককেন্দ্রিক ঝোঁক সুস্পষ্ট। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী রাজনীতির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত রাজ্যগুলির সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার দাবিতে সমবেত হওয়া। বিরোধী ঐক্য নিছক নির্বাচনী পাটিগণিতের যোগবিয়োগে সীমিত রাখিলে চলিবে না, তাহাকে যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় সংহতির রূপ দিতে হইবে। কৃষক আন্দোলন উপলক্ষে তাহার প্রস্তুতি শুরু হইয়াছে, ভাল। কিন্তু ইহা প্রথম পদক্ষেপমাত্র।