অলিম্পিক্সে পাকিস্তানি ক্রীড়াবিদ আরশাদ নাদিমের কাছে পুত্র নীরজ চোপড়া পরাজিত হওয়ার পরও তাঁর মা হাসিমুখে বলেছেন, আরশাদ নাদিমও তো আমারই সন্তান। আমার দুই ছেলেই অলিম্পিক্সে পদক জিতে ঘরে ফিরেছে। নাদিমও বলেছেন, নীরজের মা তাঁরও মা। যে পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনও ক্রীড়া-দ্বন্দ্বই ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে যুদ্ধে পর্যবসিত হয়— অস্বীকার করা চলে না যে, পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষও এই দ্বৈরথকে যুদ্ধ হিসাবেই দেখেন— সে দেশের কোনও খেলোয়াড়ের প্রতি এই স্নেহসম্ভাষণ শুধু বিস্মিতই করে না, আশ্বস্তও করে। নাদিমের মা-ও নীরজের সম্বন্ধে একই রকম স্নেহশীল। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নীরজ এবং নাদিম, উভয়েই বিশ্বমানের খেলোয়াড়। বিশ্বমঞ্চে তাঁদের দাপট এখন প্রশ্নাতীত। কিন্তু, তাঁরা এবং তাঁদের পরিবার যে সেই ক্রীড়াদক্ষতাকে উগ্র জাতীয়তাবাদের আঁচ থেকে সযত্নে আড়াল করে রাখতে চান, খেলার মাঠের দ্বৈরথকে ব্যক্তিগত বা জাতিগত বিদ্বেষের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে নারাজ, তার প্রমাণ আগেও মিলেছে, এ বারও মিলল। এর আগেও নাদিমকে খেলায় হারিয়ে তাঁকে সস্নেহে জাতীয় পতাকার নীচে ডেকে নিয়েছিলেন নীরজ। নাদিমও ‘শত্রু’ দেশের পতাকার নীচে দাঁড়াতে দ্বিধা বোধ করেননি। তবে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আশ্চর্যতর ঘটনা হল, পাকিস্তানের খেলোয়াড়ের প্রতি এমন ‘নরম’ মনোভাব সত্ত্বেও ভারতের ‘ক্রীড়াপ্রেমী’রা নীরজের প্রতি যথেষ্ট খড়্গহস্ত হননি। তাতে ক্ষীণ হলেও ভরসা জন্মায় যে, দেশপ্রেম আর পাকিস্তান-বিদ্বেষ যে এক বস্তু নয়, এই কথাটি ভারতের মানুষ হয়তো বুঝতে শিখছেন।
সত্যিই যদি তা-ই হয়, তবে তা এক অলৌকিক ঘটনা হিসাবে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য হবে। কারণ, এই বিদ্বেষ যতখানি স্বয়মাগত, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক ভাবে নির্মিত। ভারতে (এবং পাকিস্তানেও বটে) রাজনীতির কারিগরদের একটি বড় অংশের কাছে পররাষ্ট্রবিদ্বেষী উগ্র জাতীয়তাবাদ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি জোরালো অস্ত্র। দেশভাগ নামক ক্ষতটিকে ৭৭ বছর ধরে যে ভাবে জিইয়ে রাখা হয়েছে, যে ভাবে প্রতি সুযোগেই উগ্র গৈরিক জাতীয়তাবাদ সেই স্মৃতিকে উস্কে দিতে চায়, খেলার মাঠে পাকিস্তান-বিদ্বেষ তারই একটি রূপ। সেই রূপকল্পনায় পাকিস্তান শত্রু তো বটেই— ভারত যা খুইয়েছে, পাকিস্তান যেন তার মূর্ত প্রতীক। অতএব, খেলার মাঠের বিদ্বেষ আসলে সেই ঐতিহাসিক ক্ষতে মলম লাগানোর প্রয়াস— সে মলমের চরিত্র এমনই, যাতে ঘায়ের উপশম হয় না, বরং তা আরও দগদগে হয়ে ওঠে, শত্রুতা আরও বাড়ে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই শত্রুতা মহার্ঘ— সীমান্তের ওপারের শত্রুর জুজু দেখিয়ে যেমন ভোট চাওয়া যায়, তেমনই দেশের সংখ্যালঘুদেরও সেই খেলা উপলক্ষে চিহ্নিত করা যায় শত্রুর প্রতীক হিসাবে। ভারতের বহু মুসলমান পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার দিন আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকেন, কে জানে কোন মুহূর্তে তাঁদের বাড়ির উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত হতে পারে ইট, অথবা চড়াও হবে উগ্র জাতীয়তাবাদের মদে মত্ত জনতা।
এই পটভূমিকায় নীরজ চোপড়ার মা সরোজ দেবী এবং আরশাদ নাদিমের মা রাজ়িয়া পরভীন, উভয়ের মন্তব্যই অমূল্য। বিশেষত, তাঁরা মা বলেই— এই উপমহাদেশে মায়ের আবেগের সামাজিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব এখনও অনস্বীকার্য। সেই মা যদি সীমান্তের ওপারের প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়কে সন্তানের মর্যাদা দিতে পারেন, তবে তা জনমতকেও হয়তো খানিক দ্রব করে। হয়তো মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে যে, বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে পাওয়া যায় আত্মার উষ্ণতা। কেউ বলবেন, জ্যাভলিন থ্রো ক্রিকেটের মতো উপমহাদেশীয় ধর্ম নয় বলেই অনেক সহজে এই স্নেহের বার্তা জনগ্রাহ্য হয়েছে। কথাটি যদি ঠিকও হয়, তবু কোনও একটি মুহূর্তে বিদ্বেষের শেষের শুরু হওয়া প্রয়োজন ছিল। এ বার এই আত্মীয়তার বোধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি সকলের।