প্রতীকী ছবি।
রাজস্থানের জালোর জেলার সুরানা গ্রামের শিক্ষক চালি সিংহ ভারতকে এই ‘শিক্ষা’ দিলেন যে, ভারতে বর্ণবিদ্বেষের নখ-দাঁত আগের মতোই ধারালো। উচ্চবর্ণের কলসি থেকে জলপান করা কত বড় অপরাধ, মৃত্যুযন্ত্রণায় তা উপলব্ধি করে গেল ন’বছরের বালক ইন্দ্র মেঘওয়াল। দলিত-আদিবাসীদের দমন-পীড়নের সমর্থনে সদাপ্রস্তুত স্কুল, পঞ্চায়েত, পুলিশ, হাসপাতাল। আইনের বাণী তাদের দোরগোড়ায় থমকে যায়, অন্দরে প্রবেশ করে না। না হলে ভারতের কোনও স্কুলে উচ্চবর্ণের জন্য আলাদা কলসি থাকবে কেন? কেনই বা শিক্ষার অধিকার আইন থাকা সত্ত্বেও ছাত্রের গায়ে শিক্ষক হাত তুলবেন? শিশুনিগ্রহের মতো ভয়ানক অপরাধ ঘটার পর পঞ্চায়েতের পাশে দাঁড়ানোর কথা। ইন্দ্রের পরিবারকে কোনও জনপ্রতিনিধি সাহায্য করেননি, বরং এলাকার উচ্চবর্ণ মুরুব্বিরা আহত বালকের পরিবারকে টাকা নিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে ক্রমাগত চাপ দিয়েছে। তৎসত্ত্বেও থানায় গেলে অভিযোগকারীর বয়ানকে নস্যাৎ করে পুলিশ ঘটনাটিকে লঘু করেছে। দাবি করেছে, ওই স্কুলে জল খাওয়ার জন্য কলসির ব্যবস্থাই নাকি নেই। ইন্দ্র নানা হাসপাতালে চব্বিশ দিন ঘুরে, অবশেষে আমদাবাদ সিভিল হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় তার। এত দীর্ঘ দিন, এতগুলি হাসপাতালে কী চিকিৎসা হয়েছিল, কেন যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থায় উদ্যোগী হয়নি জেলা প্রশাসন অথবা স্বাস্থ্য আধিকারিকরা, তা স্পষ্ট নয়। আন্দাজ হয়, দরিদ্র ও দলিত, এই দুইয়ের প্রভাব কাজ করেছিল হাসপাতালেও।
অতঃপর সে প্রভাব কাজ করবে বিচার প্রক্রিয়ায়, সে আশঙ্কা যথেষ্ট। উত্তরপ্রদেশের হাথরসে এক দলিত তরুণীর গণধর্ষণ, হত্যা এবং পুলিশের দ্বারা তার দেহ জ্বালিয়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার যে ঘটনা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঘটেছিল, তা দেখিয়ে দেয়, রাষ্ট্রের থেকে দলিতের সুবিচার পাওয়ার আশা কতটুকু। ২০২০ সালে দলিতদের প্রতি হিংসার অভিযোগ দায়ের হয় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি, তার মধ্যে ৩৩৭২টি অভিযোগ ধর্ষণের, ১১১৯টি হত্যার চেষ্টা, এবং ৮৫৫টি হত্যার। এই সব সংখ্যার অন্তরালে রয়েছে কত বিধ্বস্ত, বিপন্ন জীবন, কত অগ্নিদগ্ধ ঘরবাড়ি, কত স্বজনহীন মানুষ, আন্দাজ করা কঠিন নয়। একটি হিসাব মতে, ভারতে প্রতি দশ মিনিটে এক জন দলিত আক্রান্ত হন। ঘোড়ায় চড়ার জন্য, মন্দিরে প্রবেশের জন্য, জল পান করার জন্য আজও আক্রান্ত, নিহত হতে হয় দলিতদের, একবিংশের ভারতে এর চাইতে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে? আদালতে দলিত-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলা চলছে সাঁইত্রিশ হাজারেরও বেশি, তিন জন অভিযুক্তের দু’জনই বিচারে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়, বলছে সরকারি তথ্য।
দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রতিক্রিয়া যে প্রায়ই জনরোষ প্রকাশের আকার নেয়, তা এই কারণেই। অপরাধ ঘটে ব্যক্তির উপর, কিন্তু সমগ্র দলিত সমাজ আন্দোলিত, বিক্ষুব্ধ হয়। কারণ উচ্চবর্ণের প্রহার, ধর্ষণের নিশানা কেবল কোনও ব্যক্তি তো নয়, সমাজে নিম্নবর্ণের ‘স্থান’ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার উদ্দেশেই ব্রাহ্মণ, রাজপুত, অন্যান্য সবর্ণ জাতি ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ দিতে চায় দলিত বালক, নারী, যুবকদের। কেবল চালি সিংহ নয়, ইন্দ্র মেঘওয়ালের মৃত্যুর ঘটনাকে গোপন করা, লঘু করার চেষ্টায় জড়িত সকলের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রয়োজন।