পশ্চিমবঙ্গে আর এক বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। যে প্রকল্পের উপর বহু গ্রামীণ পরিবার নির্ভরশীল, সেই মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা— এমজিএনআরইজিএ, বা চালু কথায়, একশো দিনের কাজ— অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, রাজ্য সরকার নিজস্ব তহবিল গড়ে প্রকল্প চালাতে চাইছে। রাজ্যের অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে এর ধাক্কা কত গুরুতর হবে, তা কল্পনা করাও কঠিন। অথচ, কোনও আলোচনা ছাড়াই এই ‘বিকল্প’ কাজে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কেন্দ্র গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে বকেয়া মজুরি দিচ্ছে না। তাই রাজ্যের পূর্ত, পঞ্চায়েত, সেচ, উদ্যানপালন প্রভৃতি দফতর নিজস্ব প্রকল্পগুলিতে জব কার্ডধারী শ্রমিকদের নিয়োগ করবে। বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল গঠন করে মজুরি মেটাবে রাজ্য। ইতিমধ্যেই পূর্ত দফতর অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগের উপযোগী প্রকল্প চিহ্নিত করে জেলায় পাঠাচ্ছে, জেলা পাঠাচ্ছে ব্লকে। হে কর্মতৎপর রাজকর্মচারী-গণ, তিষ্ঠ ক্ষণকাল! সরকারি দফতর-নির্দিষ্ট কাজ করতে ব্লক অধিকর্তারা গ্রামবাসীকে নিয়োগ করবেন— এই পরিকল্পনা যে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা আইনকে কার্যত হেঁটমুণ্ড-ঊর্ধ্বপদে দাঁড় করিয়ে দেয়, তা কি বড়-মেজো আধিকারিকদের কারও মনে হয়নি? গ্রামের মানুষের সমবেত আলোচনায় নির্দিষ্ট কাজ গ্রামবাসীর শ্রমে রূপায়ণ করবে তাঁদেরই নির্বাচিত সরকার— স্বনির্ভরতার এই আদর্শে তৈরি হয়েছিল এনআরইজিএ। আর আজ পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্ক-প্রসূত পরিকল্পনায় গ্রামবাসী পরিণত হচ্ছেন দিনমজুরে, নিয়োগকর্তা সরকার। এমন আইনগত, নীতিগত সিদ্ধান্ত কী করে যথেষ্ট বিতর্ক-বিবেচনা ছাড়া গৃহীত হতে পারে? সর্বোপরি, বাড়তি অর্থসংস্থান হবে কী করে, সে আলোচনারও কি দরকার নেই?
কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না কেন? সংবাদে প্রকাশ, এ বছর এই রাজ্যের প্রস্তাবিত তিন হাজার কোটি টাকার ‘লেবার বাজেট’ পাশ করেনি কেন্দ্র। তা কি হিসাবের গরমিলের কারণে, না কি রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে? কারণ যা-ই হোক না কেন, সমাধানের দায়িত্ব প্রশাসন তথা শাসক দলের। পশ্চিমবঙ্গ প্রকল্পের খরচে শীর্ষস্থানে থাকা সত্ত্বেও এত বছর টাকা পেয়েছে, এখন বন্ধ হল কেন, স্পষ্ট উত্তর পাওয়ার অধিকার রাজ্যবাসীর আছে। রাজ্যে কর্মসংস্থান যোজনায় দুর্নীতির অজস্র দৃষ্টান্ত মিলেছে। সেগুলির নিরসন হয়েছে কি? সরকারি হিসাবে গরমিলের জন্য কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না, তাই রাজ্যবাসীর করের টাকায় বকেয়া মজুরি মেটাতে হবে— এ কেমন প্রস্তাব? দ্বিতীয় প্রশ্ন, গ্রামের মানুষের কাজের বিপুল চাহিদার জোগান দেবে আধ ডজন সরকারি দফতর, এ কি বিশ্বাসযোগ্য? নিয়োগ, নজরদারি, নিয়ন্ত্রণের জন্য যত কর্মী প্রয়োজন, সরকারি দফতরগুলিতে তার কতটুকু রয়েছে? ঠিকাদারি, ‘কাটমানি’ প্রথার শিকার হবেন কর্মীরা, সে সম্ভাবনা যথেষ্ট। পূর্ত বা সেচ দফতরের কাজের ‘সামাজিক অডিট’ কি সম্ভব? যেন তেন প্রকারেণ মজুরিদান কোনও প্রকল্পের উদ্দেশ্য হতে পারে না।
এখানে একটি কথা স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন— রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিস্পর্ধী প্রতিষ্ঠান নয়। উভয়ের কাজ এক নয়, ক্ষমতাও তুলনীয় নয়। ফলে, কেন্দ্র কোনও কাজ না করলে রাজ্য সরকারই তা করে নেেব, এই ভঙ্গিতে রাজনীতির উপকার হতে পারে, রাজ্যের উপকার হবে না। গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার কাজ চালিয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব। কেন্দ্র সেই কাজে ব্যর্থ হলে তার উপর চাপ তৈরি করতে হবে; রাজ্যের তরফে কোনও গাফিলতি থাকলে শুধরে নিতে হবে সেটাও। কিন্তু কেন্দ্র না করলে রাজ্যই করে নেবে, এই মনোভাবটি বিপজ্জনক। রাজকোষের পক্ষেও সেই বিপদটি কম মারাত্মক নয়।