গত ২ সেপ্টেম্বর কোচিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার পথে আরও এক ধাপ এগোল ভারত। গত ২ সেপ্টেম্বর কোচিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে আইএনএস বিক্রান্ত তুলে দেওয়ার ফলে শুধুমাত্র যে ভারতের হাতে দ্বিতীয় এক বিমানবাহী রণতরী এল তা-ই নয়, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বিক্রান্ত ভারতকে সেই আন্তর্জাতিক কুলীন গোষ্ঠীতে স্থান দিল, যারা একক প্রচেষ্টায় এ-হেন বৃহৎ মাপের রণতরী বানাতে সক্ষম। সুতরাং, ২ সেপ্টেম্বরের গুরুত্ব ভারতের কাছে দ্বিমাত্রিক। প্রথমত, প্রথম বিশ্বের দেশ না হয়েও ভারতীয় প্রযুক্তি প্রায় ত্রিশটি বিমান ওঠানামার পরিকাঠামোযুক্ত রণতরী নির্মাণে সক্ষম— বিশ্বকে এই বার্তা দিতে পারা। এবং দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ায় নিজ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও পোক্ত করা। ইতিমধ্যেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক হিসাবে চিনের নিজ অবস্থানটি দৃঢ় করার প্রচেষ্টা, ভারত মহাসাগরে প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিত এবং দ্রুত রণতরীর সংখ্যাবৃদ্ধির উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ভারতের এই পদক্ষেপের আশু প্রয়োজন ছিল। এই কৃতিত্ব গৌরবের বইকি!
অবশ্য একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এই কৃতিত্ব কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়। নৌবাহিনীর গর্বের মুহূর্তেও যে ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গটি উঠল, তার কারণ কোচির অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। দেশের উন্নয়নে পূর্বসূরিদের অবদান বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সচরাচর মুখে কুলুপ এঁটে নিজ মহিমা সঙ্কীর্তনেই বিশ্বাসী। সেই ধারা অনুসরণ করে তিনি সে দিনও কৃতিত্বের প্রায় সবটুকুই আত্মসাৎ করেছেন। প্রসঙ্গত, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নততর করে তোলার প্রক্রিয়া ধারাবাহিক, সরকার-নির্দিষ্ট নয়। এবং ইতিহাস সাক্ষী, বিক্রান্তের নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নৌ-বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তকরণ পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রাপথটি অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিংহ প্রমুখের অবদানে ঋদ্ধ। তারও পূর্বে প্রথম আইএনএস বিক্রান্তকে নৌসেনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় নেহরুর আমলে। এই সম্মিলিত প্রয়াসের পরিণতিতেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর ঢাকটি আবারও বাজাতে পেরেছেন। সুতরাং, ভাষণে অন্যদের অনুল্লেখ এক আত্মকেন্দ্রিক, রাজনীতিসর্বস্ব মানসিকতার প্রতিফলন। প্রতিরক্ষার প্রশ্নেও যে প্রধানমন্ত্রী সেই মানসিকতা বজায় রাখলেন, এটাই আশ্চর্যের!
এবং একই দিনে তিনি নতুন প্রতীক-যুক্ত নৌবাহিনীর পতাকারও উন্মোচন করলেন। নৌবাহিনীর পতাকায় প্রতীক পরিবর্তন নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এই বার ঔপনিবেশিক আমলের স্মৃতিবাহী সেন্ট জর্জ’স ক্রস সরিয়ে সেখানে জাতীয় পতাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছত্রপতি শিবাজির সময়ের মুদ্রার প্রতীক। মরাঠারাজ শিবাজি ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীকস্বরূপ। নৌবাহিনীর প্রতীকে তাঁকে স্থান দেওয়ার অর্থ সেনাবাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিটি নষ্ট করার সচেতন প্রয়াস। তাঁর ভাষণের মধ্য দিয়েও যেন প্রধানমন্ত্রী প্রকারান্তরে বোঝাতে চেয়েছেন, ঔপনিবেশিক গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে নৌসেনা অতঃপর হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে পা বাড়াল। স্মরণে রাখা ভাল, একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী কোনও দলীয় মতাদর্শ প্রচারের স্থান নয়। নৌবাহিনীর এক উজ্জ্বল দিনে ঠিক সেই কাজটিই করে নরেন্দ্র মোদী দেশের গৌরবকেই খাটো করলেন।