প্রতীকী ছবি।
কোভিড সংক্রমণের হার যখন ফের চরমে, তখন একের পর এক টিকাকরণ কেন্দ্রের বাহিরে ঝুলিতেছে বিজ্ঞপ্তি: ‘জোগানের অভাবে টিকাকরণ বন্ধ’। সম্ভাবনা ছিল যে, ভারত বিশ্বের ‘টিকা রাজধানী’ হইবে— গোটা দুনিয়ার টিকার জোগান দিবে ভারতীয় উৎপাদকরা। এখন আন্তর্জাতিক বাজার হইতে টিকা কিনিবার তাড়নায় ভারত ন্যূনতম সতর্কতাও পরিহার করিল। জানাইল, আমেরিকা, ব্রিটেন বা জাপানের ন্যায় দেশে যদি কোনও টিকা ছাড়পত্র পাইয়া থাকে, তবে ভারতে তাহার আর দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আয়োজনের দরকার নাই। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, দেশভেদে টিকার কার্যকারিতার ফারাক হইতে পারে, এই কথাটি জানিবার পরও বিনা ট্রায়ালে ভারতের বাজারে এই বিদেশি টিকাগুলিকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া কি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নহে? উত্তরটি প্রধানমন্ত্রীও জানেন, স্বাস্থ্যকর্তারাও। কিন্তু এই মুহূর্তে দেশে টিকার যে অভাব দেখা দিয়াছে, তাহাকে সামাল দিতে এই ঝুঁকি লওয়া ভিন্ন কোনও উপায় তাঁহাদের সম্মুখে ছিল না। এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়— উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে যদি নীতিগত সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব ফেলিতে দেওয়া হয়, তবে বিপদ না ঘটাই আশ্চর্যের। স্বদেশি গর্বে গরীয়ান হইবার পূর্বে কর্তারা যদি হিসাব কষিয়া দেখিতেন যে, কোন মাসে কত টিকা প্রয়োজন হইতে পারে, এবং ভারতীয় উৎপাদকরাই সেই জোগান দিতে পারিবেন কি না, তবে আজ এমন মরিয়া সিদ্ধান্ত করিতে হইত না। বিশেষজ্ঞরা জানাইয়াছেন, ভারতে প্রত্যহ টিকাপ্রদানের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির হইয়াছে, জোগানের ব্যবস্থা তাহার অর্ধেক। আরও বড় বিপদ, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই কথাটি স্বীকার করিতেই নারাজ।
অবশ্য, দেশের বাজারে টিকার এই অভাব উৎপাদকদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে ঘটিতেছে, না কি সরকারের দূরদৃষ্টির অভাবের ফলে, সেই প্রশ্নের উত্তরও প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হইবে। ভারতের অন্যতম উৎপাদক পুণের সিরাম ইনস্টিটিউট একাধিক বার সরকারের নিকট আবেদন করিয়াছিল যে, তাহাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকার সাহায্য করুক। এবং, কোন মাসে কত টিকা সরকার কিনিবে, তাহার আগাম চাহিদা পেশ করিয়া রাখুক, যাহাতে সংস্থার পক্ষে উৎপাদন বৃদ্ধি সহজতর হয়। কেন্দ্রীয় সরকার কোনওটিই করে নাই। ফলে, যেখানে চাহিদা ও জোগানের সামঞ্জস্য বজায় রাখিয়া সাধারণ মানুষের জন্য টিকা নিশ্চিত করা যাইত, সেখানে এক বিপুল অনিশ্চয়তা তৈরি হইয়াছে। সরকারের নিকট চাহিদার আশ্বাস না পাওয়ায় বিদেশে টিকা রফতানি করা হইয়াছে, যাহাতে দেশের বাজারে ঘাটতি আরও বাড়িয়াছে।
ইহা কি শুধুই অপদার্থতা, না কি গভীরতর কোনও কারণ আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বাধীন বেসরকারি পুঁজির প্রতি নাগপুরের সুগভীর অবিশ্বাসের কথাটি উঠিয়া আসিবে। বর্তমান সাঙাততন্ত্রের প্রাবল্য দেখিবার পরও প্রশ্ন করিতে হয়, গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা কি আদৌ পুঁজির কুশলতায় বিশ্বাসী? না কি, তাঁহারা পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহেন, নিজেদের অঙ্গুলিহেলনে চালাইতে চাহেন? প্রশ্নটি জরুরি, কারণ পুঁজিবাদ আর সাঙাততন্ত্র সম্পূর্ণ পৃথক দুইটি ব্যবস্থা— দ্বিতীয়টি প্রথমটির ভেক ধারণ করে মাত্র। সমাজবাদের বিরোধী হইয়াও ‘গৈরিক দক্ষিণপন্থী’রা এই শীর্ষ হইতে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দর্শনে বিশ্বাসী। সেই বিশ্বাসের সহিত যদি যোগ হয় অস্বচ্ছতা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণে অনীহা ইত্যাদি, তবে যে বিপদ ঘটিবার, ভারতে তাহাই ঘটিতেছে। সরকার যদি বেসরকারি উৎপাদক সংস্থার উপর ভরসা রাখিত, প্রয়োজনীয় সাহায্যের ব্যবস্থা করিত, তাহা হইলে আজ ভারত হয়তো সত্যই বিশ্বের ‘টিকা রাজধানী’ হইতে পারিত। পরিবর্তে, প্রভূত ঝুঁকি লইয়া অপরীক্ষিত টিকা কিনিতে হইতেছে।