ক্ষুধা।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী ক্ষুধাহীন হবে। সেই লক্ষ্যের পথে দুনিয়া কত দূর অগ্রসর হল, তা মাপতে ২০০০ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছরই ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে আয়ার্ল্যান্ড ও জার্মানির দুই অসরকারি সংস্থা। এই সূচক নির্ণয় করতে যে চারটি মাপকাঠি ব্যবহৃত হয়, সেগুলি হল: জনসংখ্যার কত শতাংশের প্রয়োজনের তুলনায় কম পুষ্টির ব্যবস্থা হচ্ছে, অর্থাৎ নির্ধারিত মাপের তুলনায় কম ক্যালরি ইনটেক হচ্ছে; বাচ্চাদের ওয়েস্টিং, অর্থাৎ পাঁচ বছর বা তার কম বয়সি শিশুদের মধ্যে কত শতাংশের ওজন নির্দিষ্ট উচ্চতার তুলনায় কম; স্টান্টিং, অর্থাৎ পাঁচ বছর বা তার কম বয়সি শিশুদের মধ্যে কত শতাংশের উচ্চতা নির্দিষ্ট বয়সের তুলনায় কম; এবং শিশুমৃত্যুর হার। সেই সূচকের ক্রমতালিকায় প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে উন্নতি করছিল ভারত। ২০১৪ সাল থেকে সেই ধারা পাল্টায়। চারটি মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে তৈরি এই সূচকটিতে ভারতের অবস্থানের অবনতি ঘটতে থাকে। ২০১৪ সালটি নেহাতই সমাপতন, না কি তার কোনও গভীরতর তাৎপর্য আছে, আপাতত সেই প্রশ্নটিতে ঢোকার প্রয়োজন নেই। এই বছরের সূচকের ক্রমতালিকায় ভারত ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭তম স্থানে রয়েছে। ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, এমনকি পাকিস্তানও। চিনের সঙ্গে কোনও তুলনার অবকাশই নেই, কারণ বিশ্বের প্রথম ১৭টি ক্ষুধামুক্ত দেশের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে চিন। তবে, ভারতের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে আফগানিস্তান।
এই তথ্য প্রকাশ্যে আসায় শাসকরা লজ্জিত হতে পারতেন। কিন্তু, সেই লজ্জা সম্ভবত ভিন্ন কোনও সাধনার ফল। কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে যে, তারা এই রিপোর্টের ফলাফলকে স্বীকার করছে না, এবং এই রিপোর্টটিকে ভারতের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টা হিসাবেই দেখছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রিপোর্টটি গ্রহণযোগ্য নয় কেন, তার কয়েকটি কারণ সেই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের প্রধানতম আপত্তি হল, সামগ্রিক ক্ষুধার সূচক নির্মাণের ক্ষেত্রে চারটি মাপকাঠির মধ্যে তিনটিই কেন শিশুস্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। অন্য আপত্তি হল, সরকারের মতে, এই সমীক্ষাটিতে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশন-এর (এফএও) ‘ফুড ইনসিকিয়োরিটি এক্সপেরিয়েন্স স্কেল’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে একটি ছোট নমুনাসংখ্যাকে গত এক বছরে তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তার অভাবের ‘অভিজ্ঞতা’ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয় মাত্র। কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য, ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে এই ছোট নমুনা সমীক্ষা প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরতে পারে না। অস্যার্থ, ভারতে সমস্যা নেই, যত গোলমাল রিপোর্টেই।
গত বছরও ভারত এই আপত্তিটি করেছিল। তখন গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে, দাবিটি ভিত্তিহীন। সংস্থার ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা রয়েছে যে, ভারত-সহ সব সদস্য দেশের প্রদত্ত তথ্য ব্যবহার করে এফএও যে ফুড ব্যালান্স শিট তৈরি করে, তাকেই কম পুষ্টির মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। খুঁটিনাটির মধ্যে ঢোকার প্রয়োজন নেই— মূল কথাটি হল, কেউ আশঙ্কা করতেই পারেন যে, ভারত নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অপযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে। এই প্রবণতাটি নতুন নয়। ক্ষুধার সূচকের ক্ষেত্রেই অতীতে ভারত এই কাজটি করেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রবণতাটি একই— ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা থেকে উন্নয়নে খামতি, যে বিষয়েই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ভারতের শাসকদের পক্ষে প্রতিকূল হয়েছে, তাতেই ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চক্রান্তের সন্ধান পেয়েছেন শাসকরা। উন্নয়নে খামতি থেকে গেলে অতি জাতীয়তাবাদ দিয়ে যে তা পূরণ করা যাবে না, কেন্দ্রীয় সরকার এই বার কথাটি বুঝলে মঙ্গল।