—প্রতীকী চিত্র।
বিমা সংস্থার যেমন অধিকার আছে গ্রাহকের বিষয়ে সব প্রাসঙ্গিক তথ্য জানার, গ্রাহকেরও অধিকার আছে বিমার সব শর্ত জানার— এক মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে শোনা গেল এই কথাটি। আদালতের এই অবস্থানটি অতি স্বাগত। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, অর্থনৈতিক উদারীকরণের সাড়ে তিন দশক পরেও আদালতকে এই কথাটি বলে দিতে হয়। প্রতিযোগিতার বাজারের একটি মৌলিক শর্ত হল তথ্যের সমতা— অর্থাৎ ক্রেতা এবং বিক্রেতা, উভয় পক্ষের কাছেই সমান তথ্য থাকবে। বিমার মতো পণ্যের ক্ষেত্রে এই তথ্যের সমতার প্রশ্নটির গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ নিয়মিত কিস্তি জমা করার পরও যখন বিমার টাকা পাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তখন বহু ক্ষেত্রেই বিমা সংস্থা জানায় যে, কোনও একটি নির্দিষ্ট শর্ত লঙ্ঘিত হওয়ায় গ্রাহক বিমার টাকা পাবেন না। এই অবস্থায় গ্রাহকের পক্ষে পুরনো প্রিমিয়াম ফিরে পাওয়ার প্রশ্ন থাকে না তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা হল, যে কারণে লোকে বিমা কেনে, সেই উদ্দেশ্যটিই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়। এমন লেনদেনের সূচনাতেই যাবতীয় শর্ত স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গ্রাহককে বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। তাঁর জানা বিধেয়, কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি বিমার টাকা পাবেন, কোন ক্ষেত্রে পাবেন না। সেই পাওয়া না-পাওয়ার তুল্যমূল্য বিচার করে গ্রাহক বিমাটি কেনা বা না-কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। সঙ্কটকালে তাঁকে কোনও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না। এই সামান্য কাজটিও সংস্থাগুলি স্বপ্রবৃত্ত হয়ে করতে পারে না কেন, সে প্রশ্ন করা প্রয়োজন।
গ্রাহক এবং বিক্রেতার মধ্যে ক্ষমতার উচ্চাবচতা অনস্বীকার্য। বিমার মতো পণ্যের ক্ষেত্রে, হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে, অথবা আর্থিক বাজারের কার্যত যে কোনও পণ্যের ক্ষেত্রেই ক্রেতার সামনে দু’টি বিকল্প থাকে— হয় তিনি পণ্যটি কিনতে পারেন, অথবা না-কিনতে পারেন। পণ্য বিক্রির শর্ত কী হবে, অথবা কোনও লুকোনো চমক থাকবে কি না, তা নির্ধারণ করার অধিকার গ্রাহকের থাকে না। প্রকৃত প্রতিযোগিতার বাজারে এই সমস্যা তৈরি হয় না— কারণ সেখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতা, উভয়েরই সংখ্যা অসীম, ফলে কারও হাতেই বাজারের শর্ত নির্ধারণের ক্ষমতা নেই। কিন্তু, উল্লিখিত পণ্যগুলির বাজারের কথা যদি ভাবা যায়, তা হলে স্পষ্ট হবে যে, সেই বাজারে ক্রেতার সংখ্যা অগণন হলেও বিক্রেতার সংখ্যা মুষ্টিমেয়। সংখ্যার অসমতা থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার অসমতার সূত্রপাত। ফলে, তারকাচিহ্নিত ‘শর্তাবলি প্রযোজ্য’ শব্দবন্ধটি দেখার পরও গ্রাহক অনন্যোপায়। এই অবস্থাটি ক্রেতাস্বার্থের পরিপন্থী। প্রশ্ন উঠলে সংস্থাগুলি জানায় যে, গ্রাহকরা চাইলেই সম্পূর্ণ শর্তাবলি পাঠ করতে পারেন— লেনদেনের চুক্তিপত্রে সমস্ত শর্তই লেখা থাকে। কথাটি ভুল নয়। তবে, খুদে হরফে হাজার ত্রিশেক শব্দের অতি জটিল আইনি ভাষার বয়ান থেকে শর্তগুলিকে উদ্ধার করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের মধ্যে সুলভ নয়। সেই কারণেই অধিকাংশ মানুষ শর্ত পাঠ না করেই তাতে সম্মতি জানান। কিন্তু, একে গ্রাহকের গাফিলতি হিসাবে ধরে না নিয়ে প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করাই বিধেয়। সেই কাজটি সংস্থাগুলি নিজেদের তাগিদে করে উঠতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ যাতে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা হয়, তা নিশ্চিত করা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তব্য।