puri

চরণ-ধুলায়

এক দেশ, এক বিধি, এক পূজাপদ্ধতির রীতি প্রভু জগন্নাথও স্বীকার করেন নাই, এখনকার রাষ্ট্রনেতারা তুচ্ছ মনুষ্যমাত্র!

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২১ ০৫:১২
Share:

আগামী কাল পরাক্রান্ত নৃপতির সিংহাসন হইতে পথে নামিয়া আসিবার দিন, নিজ হস্তে সম্মার্জনী লইয়া পথের ধূলি পরিষ্কারের দিন। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার রথের চাকা গড়াইবার পূর্বে পুরীর রাজার এই পথ পরিষ্কার ধর্মীয় ঐতিহ্য। ইহাকে ‘ছেড়া পহেরা’ বলা হইয়া থাকে। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্য যখন পুরীতে, সেই দিনও এই প্রথা ছিল। পুরীর তৎকালীন রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব কী ভাবে পথ পরিষ্কার করিতেছেন, কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে তাহার বর্ণনাও দিয়াছেন। লক্ষ জনতার ভিড়ে পুরীর রথ অবশ্যই দর্শনীয় বিশ্ব-ঐতিহ্য। করোনাবিধি গত বৎসর হইতে সেই ভিড়ে লাগাম পরাইয়াছে সত্য, কিন্তু রাজার ঝাঁট দিবার প্রথাটি অটুট। রাজত্ব রাজার নহে, দেবতার। একাদশ শতাব্দীতে পুরীধাম জগন্নাথদেবের নামে উৎসর্গীকৃত হইয়াছিল, বিজয়নগর বিরূপাক্ষ শিবের নামে। এখন গণতন্ত্রে রাজ্য উৎসর্গের বিধি নাই— শুধু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার দলের আনুকূল্যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের আকাশ-বাতাস ভরিয়াছে। রথের রশি সর্বজনীন, সেখানে জাত-বেজাত নির্বিশেষে সকলে রথ টানিবে, যে সকল অহিন্দুর মন্দির প্রবেশের বিধি নাই, তাঁহারাও দারুব্রহ্ম দর্শন করিবেন এবং তাহার পূর্বে রাজা রাস্তা ঝাঁট দিবেন, ইহাই ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যে যবন কালাপাহাড়ের মন্দির আক্রমণের কথা থাকিবে, পান্ডা এবং পুরোহিতদের চিল্কা হ্রদের নিকটে দেবমূর্তি লুকাইয়া রাখিবার কথা থাকিবে। আবার তাহার ঢের পরে মোগল সম্রাট আকবর স্বল্পায়তন খুরদা রাজ্যের রামচন্দ্র নামক ভূস্বামীকে রাজ-স্বীকৃতি দিবেন, ধর্মীয় বিধিতে কোনও হস্তক্ষেপ হইবে না বলিয়া চুক্তিপত্রে অঙ্গীকার করিবেন।

Advertisement

কিন্তু রাজার ঝাঁট দিবার এই প্রথা আসিল কোথা হইতে? পুরীর মন্দিরে এখনও ওড়িয়া ভাষায় পুরাণ, ইতিহাস ও মন্দির সংক্রান্ত কাহিনি লইয়া মাদলাপঞ্জি সংরক্ষিত। তাহাতে দেখা যাইতেছে, একাদশ শতাব্দীতে কটকের রাজা চোড়গঙ্গার আমলে জগন্নাথ মন্দির প্রথম প্রাধান্য পায়। তাঁহার পুত্র তৃতীয় অনঙ্গভীম ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে পুরীসফরে যান, কলিঙ্গ রাজ্য জগন্নাথদেবের নামে উৎসর্গ করেন। অনঙ্গভীম সিংহাসনে নিজ অভিষেকও বাতিল করেন— তিনি তো রাজা নহেন, রাজা স্বয়ং জগন্নাথ। তিনি প্রতিনিধিমাত্র। মাদলাপঞ্জি বলে, বিশিষ্টাদ্বেতবাদের প্রবক্তা, বৈষ্ণব সাধক রামানুজও পুরীতে আসিয়াছিলেন; পান্ডা ও পুরোহিতদের রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, বারংবার ভোগদানের রীতিতে বিরক্ত হইয়া প্রথা বদলাইতে চাহেন। পরে স্বয়ং জগন্নাথদেব দার্শনিক-সন্ন্যাসীকে স্বপ্নে জানান, প্রথা যেমন চলিতেছে, চলিবে। এক দেশ, এক বিধি, এক পূজাপদ্ধতির রীতি প্রভু জগন্নাথও স্বীকার করেন নাই, এখনকার রাষ্ট্রনেতারা তুচ্ছ মনুষ্যমাত্র!

এই চোড়গঙ্গা আমলেই ‘ছেড়া পহেরা’ প্রথার উদ্ভব, কিন্তু তখন কটক রাজ্যের এত খ্যাতি ছড়ায় নাই, স্থানীয়রা ব্যতিরেকে কেহ রথের কথা জানিতেন না। শেষ চোড়গঙ্গা রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। সিংহাসনে আরোহণ করেন অন্ধ্রপ্রদেশের কপিলেন্দ্র দেব। তিনিও জগন্নাথদেবকে রাজ্য উৎসর্গের প্রথা বদলান নাই। তাঁহার আমলেই ওড়িয়া ভাষায় সরলা দাস মহাভারত অনুবাদ করেন, সেখানে সমুদ্রস্রোতে কী ভাবে কাষ্ঠ ভাসিয়া আসে, জগন্নাথদেবের নবকলেবর হয়, সেই আখ্যান স্থান পায়। কপিলেন্দ্রের পুত্র পুরুষোত্তম দেব দিগ্বিজয়ী বীর, মাদলাপঞ্জির গল্পে তিনিও রহিয়াছেন। তিনি কাঞ্চীর রাজকন্যাকে বিবাহে উন্মুখ, কিন্তু কাঞ্চীরাজ রথের দিন তাঁহাকে ঝাড়ু দিতে দেখিয়া প্রস্তাব নাকচ করিলেন, ঝাড়ুদারের হস্তে কন্যা সম্প্রদান করিবেন না। ক্রুদ্ধ পুরুষোত্তম কাঞ্চী আক্রমণ করিলেন, রাজকন্যাকে বিজয়ী বীর ওড়িশায় তাঁহার মন্ত্রীর নিকটে পাঠাইয়া দিলেন। কঠোর নির্দেশ, কোনও ঝাড়ুদারের সহিত এঁর বিবাহ দিতে হইবে। মন্ত্রী রাজকন্যাকে লুকাইয়া রাখিলেন। পর বৎসর রথের পূর্বাহ্ণে রাজা যখন পথ সম্মার্জনায় ব্যস্ত, রাজকন্যা পশ্চাৎ হইতে তাঁহার গলায় মাল্যদান করেন। ক্রুদ্ধ ও বিস্মিত রাজার প্রশ্নে মন্ত্রী পাল্টা জানান, “যোগ্য ঝাড়ুদারকেই উনি বরমাল্য দিয়াছেন। জগন্নাথের সম্মুখে স্বীকার করুন, আপনি ঝাড়ুদার নহেন!” নৃপতি কী আর কহিবেন! প্রসঙ্গত, এই পুরুষোত্তম দেবের পুত্র প্রতাপরুদ্র দেবের আমলেই শ্রীচৈতন্যের শ্রীক্ষেত্র সফর। লোকব্যবহারে সিদ্ধ ওড়িয়া প্রথাটি গৌড়ীয় সন্তান সহজ ভাবেই লইয়াছিলেন, দৃষ্টিকটু ঠেকে নাই। আধুনিক গণতন্ত্রের ভোটসিদ্ধ নৃপতিরা কবে যে স্বহস্তে সম্মার্জনী লইয়া পথের ধূলি সাফ করিবেন, তাহা স্বয়ং জগন্নাথই জানেন!

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement